অর্থিতা মণ্ডল এর গুচ্ছ কবিতা
লোকজাত
এই মুহূর্তে তুমি বোবা হলে ধ্যানচক্র ভেঙে উঠে দাঁড়ান রাধা,
এখানে কৃষ্ণ প্রেমিকের আর্তি নিয়ে অশ্রু সাজান রোজ
খই ছড়ানো আলোয় গৃহস্থালি মুছে যাচ্ছে মুহূর্মুহূ
আর অবিশ্রান্ত চিৎকারের ভেতর আমাদের নিঃশব্দ পরিভ্রমণ –
চারিদিকে দেবতার অহং ছুঁয়ে তীব্র হচ্ছে মৃত্যুগন্ধ
তবুও তো শিকড় ছুঁয়েছি দ্যাখো –
ঈশ্বর চোখ মুছে ফুল বাড়েন ঈশ্বরী সকাল
রাধার আলোয় বারবার বেঁচে ওঠেন কৃষ্ণ আগুন আমার
শৈবাল
কোনো কোনো রাত এভাবেই কেটে যায়। কোনো কোনো রাত কিংবা মৃত্যুর প্রহর -
কত দূরে তুমি, শ্যাওলা জমে প্রাত্যহিক আবেশে
তবুও তো তোমার জ্যোৎস্নার ভেতর আমার আয়ু,
নিঃশব্দে পুড়ে যাচ্ছে অন্তঃস্তল, এভাবেই ক্রমশ সেজে উঠছে চিতা
আর মুখাগ্নির আলোয় আরও একবার মরে যায় অলীক সংসার
নির্মম
এখানে নগ্ন পুরুষ সন্ন্যাসী হন, প্রখর রৌদ্র শেষে খুলে ফেলেন জপকুণ্ড মালা
আদিরূপ গুঞ্জন তোলে, বড়ো ভয়াবহ এ কঠোর চর্যা।
বারবার ডাকে তাকে মৎসকন্যা, শিশির ধোয়া কোনো এক তীর
তাঁর নিরাবরণ শরীরে মৃগনাভি ঘ্রাণ, তিনি সন্ন্যাস জপেছেন বিস্তৃত মহাকাল
অসংখ্য হত্যার বাসর ঘিরে ডম্বরু বাজান,
ফিরে এসো বলে যায় সে, ফিরে এসো বলে যায় ঈশ্বরীআলো –
দহন
ঠিক এই মুহূর্তে অন্য কোনো কথা হবে না– বলেছিলেন তিনি
অতঃপর হত্যার গন্ধ এবং চিতার দহন আঁকলেন
বোবা অন্ধকারে তাঁর নিঃশব্দ কান্নার আওয়াজ পাচ্ছিলাম
অথচ আমার এবং তোমার কীর্তনের রঙ পছন্দ,
ফকিরি প্রেমের আলোয় বাঁধি ঘর, শিকড়ে রেখেছি যাবতীয় শোক
বীভৎস ক্ষতর ভেতর যারা মুখোমুখি বসেছিল তাদের ফুল দেই, আয়ু দেই–
তিনি ফিরে এলে এসব দহনে আমরাও ছবি হতে জানি
ঘাট
নগর এখানে বিশ্রুত, অহং ডুবে গেছে বহমান জলে
বেহুলা লখিন্দর ভাসে, ভেসে যায় প্রেম, চিতাভস্ম আগুন–
সাইকেলের টুং টাং আওয়াজ মাঝিদের ভাটিয়ালি গান ছুঁয়ে
কিশোরী প্রেমের মতো বৃদ্ধ হও রোজ। এসব লোককথা -
অবসর বিলাস হাওয়ায় কামনার দীর্ঘ দীর্ঘ শ্বাস
যাতায়াত না হয় থাক, থাক মৃত্যুকথা
ক্ষতর গভীরে বিষ ঢালি, তবুও তো মৃতভ্রণ জেগে ওঠে সুনিপুণ কলায়
মধুময়
এখন এই অরণ্যের ভেতর পরে ফেলি পাতার বল্কল
চলো মারাংগুরুর কাছে রেখে আসি নাগরিক বিলাপ,
সালন্দি নদীর জলে ধুয়ে নিচ্ছি ক্ষত,
ছবির মতো ভেসে ওঠে ঘর, মাটির দেয়াল জুড়ে সহস্র বছরের আলপনা
সমস্ত লৌকিক হঠাৎই অলৌকিক হয়,
আমাদের গভীরে আগুন জ্বালছেন দক্ষিণরায়
আমি তুমি আদিম শুশ্রূষায় পারস্পরিক রাতের সূর্যোদয় বুকে আঁকি,
সালন্দি নদী তখন বহতা যৌবন, ভুলে যায় নামের বাঁধন
মহাকাল স্রোত শুধু জেগে আছে একত্রিত যাপনের উষ্ণ
সমর্পণ
মহাশূন্যের এপার ওপার
অলৌকিক স্পর্শে মুছে যাচ্ছে শোক
সন্ধ্যাআরতি শেষে পুনর্বার মানবী হও তুমি,
পুরনো চালচিত্রে বড়ো সুখ ভাসে, আলগোছে শুয়ে আছে মা,
মানুষটি ক্ষেত করে জলচুর্ণ আলুথালু আলো–
শাঁখ বাজে, উপমহাদেশ ছুঁয়ে জোনাকিদের ভিড়
বাস্তুহীন হেঁটে যায় বাবাদের ঘর,
বুড়ো হই, বৃদ্ধ হই, তোমার জীর্ণ হাত ধরে তোমার পুরুষ
শুধু অস্থির আগুনের ভেতর অলৌকিক লৌকিক হয়
ভাঙা চৌকাঠে চাঁদ নিয়ে আমরাও হেসে উঠি, মুসাফির জাগে–
ছিন্নমূল বসতে তখন দেশ এসে পড়ে নেয় মহাজাগতিক অক্ষর
অতঃপর
একা একা নেমে যাব গভীর ভূতল,
আজন্ম প্রবাস শেষে দ্রুতগামী মুহূর্ত আমার
কোনো মায়া নেই, টান নেই। প্রিয়মুখ দ্বৈত যাপন-
সব ঘিরে শুধু এক তীব্র অভিমান
কীর্তন ছুঁয়ে থাকে আদি গান আমার তোমার
শুধু শোক আর শূন্যর নকশা বুনন মহাজাল
ছিঁড়ে যায়, আদৌ কি ছেঁড়ে ! গহন আকুতি –
প্রিয়সুখ সর্পগন্ধা বাঁশি জড়িয়ে
দীর্ঘঅন্ত নিঃশ্বাসে থেকে যাচ্ছে রক্ত, ঘাম
নিশ্চিহ্ন
এই মাত্র কিছু কি বললে? অল্প চা পান তারপর চলে গেলে
প্রবাসী মুহূর্তে রেখে গেছো প্রেম।
আপাত সম্পর্কহীন সকাল, যদিও গায়ত্রী মন্ত্র জপ করছেন সিদ্ধ পুরুষেরা
জ্যামিতিক বোঝাপড়ার ভেতর নিঃসঙ্গ অভিমান ছুঁয়ে
সুতোয় ভাসছে প্রতিশ্রুতি, বিচূর্ণ আদরকণা –
তুমি চাওনি অথচ এখনই শূন্যতা পান করলে
অস্ফূট দীর্ঘশ্বাস ইতস্তত বেহাগী সেতার
একটা নশ্বর ক্ষণ ক্রমশ বিলুপ্ত হচ্ছে ক্রমাগত
তুমি তখন চাঁদের বিন্দু মেখে সমস্ত জাগতিকতা ফ্যুৎকারে ওড়াও
জলছবি
অনির্দিষ্ট মুহূর্তে তুমি দাওয়ায় এসে বসো,
লতানো বেড়ার ফাঁকে শুক্লপক্ষ্ম তিথি
নতুন ধানের গন্ধ উষ্ণ ওম জড়িয়ে দাঁড়ালে
লৌকিকতার ভেতর চলে যাও বৃত্তাকার আলো,
এসব মহড়া ঘিরে দীর্ঘ দীর্ঘ শ্বাস –
শঙ্খলতা আলপনা জুড়ে আমাদের মঙ্গলঘট
অবিন্যস্ত বাঁশিতে ফুঁ দেই রোজ,
মহাচক্র বিন্দু ধরে জেগে ওঠেন মহাত্যাগী ধী
কিংবা আমি তুমি জলচিত্র নিদারুণ গাথা