একক কবিতা সন্ধ্যা ।। অমৃতা খেটো

amrita

অমৃতা খেটো-র এক গুচ্ছ কবিতা 

শিক্ষকের নাম ভাঙা হৃদয় 

এই ভ্রান্ত পথের শেষ কোথায়?
ভ্রমণ যেন পথবালিকার ইশারা
হরিণীর মায়াবী চোখের জাদু--
সজনেফুলের অট্টহাসি...

পথই বেপথুমতী। পথশয্যায় ঘুমন্ত কুকুর।
ক্ষুধার্ত পাকস্থলীকে সান্ত্বনা দিচ্ছে সজলধারা--
হাতে ছড়ি নিয়ে পায়চারি করছেন
ভাঙা হৃদয়ের শিক্ষক, সাবেক কালের ছেঁড়া পকেটের
অধিকারী ন্যায়নিষ্ঠ মানুষ....

ছেঁড়া পকেট , ক্ষুধার্ত পাকস্থলী আর
ভাঙা হৃদয় এরাই তো প্রকৃত
শিক্ষক...সমগ্র জীবনই ছাত্র...

 

করুণাধারা

বুদ্ধ মোনাস্ট্রি একা একা ভিজছে। ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালিয়ে "ত্রিপিটক" পড়ছেন বৃদ্ধ ভিক্ষু। এই বরফের দেশে ইলেক্ট্রিসিটি নেই। কক্ষে কক্ষে ঘুমিয়ে আছে নবীন ভিক্ষুরা। সোনার মৈত্রেয় বুদ্ধের চোখদুটি ক্রমশঃ যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে।

ভিক্ষু সারাজীবন "আর্যসত্য"র সন্ধান করেছেন। দমন করেছেন চিত্তচাঞ্চল্য। তবুও পদস্খলন কি এড়াতে পেরেছেন?

চোখ ছাপিয়ে অশ্রুফোঁটা পড়ল "ত্রিপিটকে"। পাপ তো পাপই। ক্ষমা করো তথাগত।

আকুলি বিকুলি করে অপরাধ রাখল শাস্তার চরণে।

কেমন যেন ঘোর ঘোর লাগছে। চন্দনের সুগন্ধ! বাইরে মেঘ-বৃষ্টি-কুয়াশা-অন্ধকার...
এক অপূর্ব আলোর স্রোত কোথা থেকে আসছে?
শরীর-মন খুব হাল্কা লাগছে। না, কোনও পাপবোধ
নেই। শুধুই আনন্দ...চিদানন্দ...

সোনার চোখদুটিতে শুধুই করুণার স্রোত। সেই স্রোতে ভেসে গেল ভিক্ষু। চারচোখের মহামিলন...

 

রূপকথা নয়

দোমেটে ঘর। খড়ের ছাউনি। খড়ের চালে গোঁজা আছে বৃষ্টিগন্ধমাখা রূপকথার চিঠি। ছাউনি বেয়ে লাউলতার অবাধ বিচরণ, অসংখ্য সাদাফুল ফুটে আছে।
ঘরে শীতলপাটি বিছানো আছে। শ্রাবণ সন্ধ্যার টিপটিপ বৃষ্টিতে রূপকথার পাত্রপাত্রীরা আসছে

রাজারানিরাজপুত্ররাজকন্যামন্ত্রীবণিক সবাই বসেছে শীতলপাটিতে। আমার কাছে শুনবে আধুনিক নীল দুনিয়ার গল্প।
গণতন্ত্র, মন্ত্রী, আমলা, লকডাউন, অনলাইন, নেট,
মিন্ত্রা, নাইকা, টুইটার, স্পেস, বেকারত্ব এসব জ্যান্ত কথা শুনে তাদের চোখ বিস্ফারিত...
ক্রমশঃ যেন পুবের আকাশ ফরসা হচ্ছে। রূপকথারা উঠতে চায়না। আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে...
ভীষণ ঘুম....

 

লকগেট

সবুজজ্যোৎস্নায় পাহাড়ি নদী নীলাম্বরী লিডারের পাশে বসে ছিলাম। আজ আমার অন্তিম রাত। একটার পর একটা লকগেট খুলে যাচ্ছে। ভেসে যাচ্ছে আবেগ, উৎকণ্ঠা, আতঙ্ক, ক্রোধ, লোভ। আমার দেহমন নিংড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে দ্রবীভূত অনুভূতির বর্ণমালা। ক্লান্ত হয়ে এলিয়ে পড়লাম।
বুকের মধ্যে দুন্দুভি বাজতে লাগলো। গভীর সুষুপ্তিতে
আচ্ছন্ন পৃথিবী। পা দুটো খুব ভারি বোধ হল। কোথায় আমার প্রজাপতির ডানা? আর এক লকগেট খুলে বিবমিষার স্রোত বেরিয়ে গেল। তবুও আমার অনন্তে
উড়ান হল না।
এমন তো হবার কথা নয়। ঘোমটা সরিয়ে দেখছে লিডার নদী। দেখছে পাইন-ফার-পপলার-চিনারের গভীর অরণ্য। পাহাড়ের বরফ গলতে লাগল। আসন্ন মুক্তি প্রতীক্ষায় আমি স্তব্ধ। শেষ লকগেট খুলে গেল। ভেসে গেল আমার সকল অহংকার। এতই হাল্কা বোধ করলাম যে অনন্ত আকাশে ভাসতে লাগলাম...

 

স্রোত

একটি নদীর স্রোতকথা লিখতে বসে
বারবারই নদীর কাছে চলে যাই–
রঙ্গিতা নামের নদীটি টানা টানা চোখে
আমাকে কয়েকবার জরিপ করে নেয়,
তারপর ভিজে চুল মেলে দিয়ে চুপটি
করে বসে থাকে....

আমি স্বচ্ছতোয়া নদীটির চরিত্র বোঝার
চেষ্টা করি, দেখে নিই তার রূপ-রঙ–
সে খিলখিল করে হাসতেই থাকে
তার খরস্রোতে ভেসে যায় ফুলমালা, মৃতমানুষ
নির্বিকার চিত্তে নদী মিষ্টি পান খেয়ে ঠোঁট রাঙিয়ে
আঁচল ছড়িয়ে দেয়....

সান্ধ্য-বাতাস এসে রংগিতার চারপাশে ঘুরঘুর করে–
দুজনে অনেক কথা ফিসফিস করে বলে
আমি যেন অবাঞ্ছিত কোন তৃতীয় জন–

আমার কবিতার খাতা পড়ে থাকে
রাত বড় বেশি নিশ্চুপ,
আমি বাড়ি ফিরে আসি
লেখার স্রোত হারিয়ে যায়...

 

শেষ পাঠিকা

তোমার লেখা সেই আশ্চর্য কবিতাটি
কে যেন নিয়ে গেল বৃষ্টিপাহাড়ের মাথায়–
'ঘুম' স্টেশন থেকে মেঘ-কুয়াশায় মাখামাখি হয়ে
শেষ ট্রেন চলে গেল অপরূপ শৈলমালায়...

বৃষ্টিভেজা চাঁদ ম্যাগনোলিয়া আর রডোডেনড্রন ফুলকে পাশে বসিয়ে আশ্চর্য কবিতাটি আবৃত্তি করল
কবিতার মৌতাতে জমে গেল ওক-পাইনের বনভূমি–
কানে কানে কথা বলছে রহস্যময়ী রূপময়ী মেঘেরা...

রাত্রির তৃতীয় প্রহরে চাঁদ ঘুমিয়ে পড়লে
ভেজা জ্যোৎস্নার আলোয়ানে শরীর ঢেকে কবিতাটি
বাতাসিয়া লুপ ঘুরে ঢুকে পড়ে বুদ্ধ মনাস্ট্রিতে–
এখানে এসে কবিতাটি হঠাৎ নীরব হয়ে যায়

 

আলোকপ্রাপ্তি

সেই আশ্চর্য কবিতাটি আমি বৃষ্টিরেনু দিয়ে লিখেছিলাম...সেগুনমঞ্জরী তাকে দিয়েছে মান্যতা।বাতাসে দুলে দুলে সে কবিতাটি পড়েছে...জ্যোৎস্নার প্লাবনে নারকেল গাছের পাতায় ঝিরিঝিরি আলোর নাচন দেখে রাত পাখিটি আলোর গান গেয়েছে গুনগুনিয়ে...

রূপকথারা এখানে শীতলপাটি বিছিয়ে বসে থাকে।সুয়োরানী দুয়োরানীর মধ্যে আর মনোমালিন্য নেই।রাজপুত্র মন্ত্রীপুত্র আমার কবিতাটি পড়েছে সুর করে, চিরহরিৎ অশ্রু পদাবলী...
ভোর হয়। প্রতিটি নতুন ভোর গতকালের ক্লান্তি থেকে মুক্ত...ভোরের নম্রতায় ঘুম ভাঙ্গা পাখি -চোখ মুগ্ধ...তার মুগ্ধবোধের ওপর প্রথম সূর্যের কিরণ গড়িয়ে পড়ে। ধ্যানমার্গে বিচরণ করতে করতে শ্রমণ এগিয়ে যায় আলোক প্রাপ্তির পথে...

 

পাঠ

শেষ পর্যন্ত কুসুম মুর্মু আর জবা ওঁরাওরা
নাগরিক সভ্যতার পাঠ শিখে ফেললো
হাতে আধুনিক মোবাইল, জীনস, টপ আর
লাল লিপস্টিক লাগিয়ে ফাঁকা, ফিরতি ট্রেনে
তারাও হাসি মশকরায় মেতে ওঠে,
সেলফি আর ভিডিও তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে...

শাল-মহুয়া-পিয়াল-সেগুনের বন থেকে
পাখিদের একটানা শিসের শব্দ ভেসে আসে
এইসব মেয়েদের ভালো চোখে দেখেনা জঙ্গলমহল,
সরলতাটুকু কেড়ে নিয়ে কে দেখালো তাদের
মেকি জীবনের জটিলতা মাখানো ফাঁদ?

সরকারি সুযোগ- সুবিধা নিয়ে শিক্ষা নয়
ধ্বংসের চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছে তাদের জীবন...

 

নির্জন রাতের কবিতা

মধুপূর্ণিমা। সেবক পাহাড়ের গা বেয়ে
রহস্যময়ী জ্যোৎস্না গড়িয়ে পড়ছে–
অপরূপা তিস্তার উল্লসিত স্রোতে
বনভূমির ছায়া ভাসতে ভাসতে দূরে চলে যায়
বিভিন্ন রঙের প্রেয়ার ফ্ল্যাগেরা সবই লক্ষ্য রাখে,
প্রিয় সখী রঙ্গীত নদীকে চুপিচুপি ডেকে নেয়
চঞ্চলা তিস্তা। সুখ-দুঃখের গল্পে মেতে ওঠে,
ঠান্ডার দেশে হিমের পরশে মেঘেরা জবুথবু–
ঘুমপাহাড়ের মাথায় বসে থাকা ভাবুক চাঁদকে
দেখে পাইনের বনে কারা যেন হাততালি দেয়,
নির্জন রাতের কবিতা লিখতে লিখতে
ঘুমিয়ে পড়েছে বনটিয়া আর জোনাকিরা...

 

সাতলহরি

১. সুরা ও সাকি নিয়ে রহস্য গল্প লিখতে বসি,
সুরাই ষড়যন্ত্র করে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিল।

২. বৃষ্টিভেজা চাঁদের প্রবল জ্বর, কে জানে ম্যালেরিয়া কিনা
গলায় স্টেথো ঝুলিয়ে দেখতে এল অশ্বিনীকুমার।

৩. বিশ্বজুড়ে মনখারাপের বৈচিত্র্যহীন পালাপার্বণ চলছে
পার্বণের চরিত্ররা হল কোভিদ-১৯, ওমিক্রন, মাংকি পক্স।

৪. কাকভোর চুপটি করে বসে থাকে স্লেটবর্ণ আকাশের গায়ে
শ্রাবণের মেঘলা দিনে ভোরের মাহাত্ম্য বোঝা ভার।

৫. আঁচলে বাঁধা স্বপ্নগুলো মেঝেতে ছড়িয়ে পড়লো,
স্বপ্ন কুড়োতে কুড়োতে দুচোখে ঘুম নেমে এল।

৬.আমার ভগবান আমার কাছে একান্ত ব্যক্তিগত,
আমি গুন্ডা হলে, আমার ব্যক্তিগত ভগবানও গুন্ডা।

৭.সরোবরে নেমে রাজহংসী ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নেয়
দেশি হাঁসেদের দুচোখ ভরা ঝুরো ঝুরো স্বপ্নপ্রপাত।

মহুল ওয়েব প্রকাশিত বিভিন্ন সংখ্যা



করোনা Diary



আমাদের কথা

আমাদের শরীরে লেপটে আছে আদিগন্ত কবিতা কলঙ্ক । অনেকটা প্রেমের মতো । কাঁপতে কাঁপতে একদিন সে প্রেরণা হয়ে যায়। রহস্যময় আমাদের অক্ষর ঐতিহ্য। নির্মাণেই তার মুক্তি। আত্মার স্বাদ...

কিছুই তো নয় ওহে, মাঝে মাঝে লালমাটি...মাঝে মাঝে নিয়নের আলো স্তম্ভিত করে রাখে আখরের আয়োজনগুলি । এদের যেকোনও নামে ডাকা যেতে পারে । আজ না হয় ডাকলে মহুল...মহুল...

ছাপা আর ওয়েবের মাঝে ক্লিক বসে আছে। আঙুলে ছোঁয়াও তুমি কবিতার ঘ্রাণ...