চন্দ্রকোণা শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে পিচঢালা রাস্তার পাশে বিশাল জমি একসময় বনজঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। চারপাশে বট আর পাকুড়ের গাছ। এখানেই বড় বড় গাছে স্বাধীনতা সংগ্রামের বহু নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তি যেমন হাবল ,সুবল, রাজেন্দ্র, ফাগু, যুগল ও কিশোর সহ দেশভক্ত বহু মানুষ কে অত্যাচারী ইংরেজ শাসকরা এখানকার বড় বড় গাছে ঝুলিয়ে ফাঁসি দিয়ে বিদ্রোহ দমনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। জায়গাটি চন্দ্রকোণা থানার ৬৮ নং মৌজার ৩ নং বসনছোড়া পঞ্চায়েতের অন্তর্গত ফাঁসিডাঙা।
ফাঁসিডাঙার ইতিহাস তৎকালীন সময়ে কৃষক জমিদারদের উপর ইংরেজ শাসকদের অকথ্য নির্যাতনের ইতিহাস, নৃশংসতার ইতিহাস।
ইংরেজ কোম্পানি নবাবের কাছ থেকে মেদিনীপুরের সনন্দ লাভ করার পর সেখানকার প্রজা জমিদারদের উপর উচ্চহারে কর ধার্য করে। অথচ প্রজাদের সেই কর বহন করার মতো অবস্থা ছিল না। ইংরেজরা তাদের 'পাইক, চুয়াড়' নামে অভিহিত করতো। কিন্তু এরা ছিল ভূমিজ হতদরিদ্র লোধা, মুন্ডা, শবর জাতির কৃষক প্রজা। বনজঙ্গল কেটে চাষের জমি বের করে যেটুকু ফসল ফলাতো তাতে কোনোরকমে তাদের দিন চলতো।
ইংরেজ কর্মচারীরা এদের দুঃখ দুর্দশার কথা না বুঝে জমি থেকে উৎখাত করে অন্য রাজা বা জমিদারদের সেই সব জমি বন্দোবস্ত দিতে লাগলো। এই অন্ত্যজ শ্রেণীর অধিবাসীদের মৃত্যুর প্রহর গোনা ছাড়া আর কিছু করার থাকল না। কিন্তু মরার আগে সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করতেও তারা রাজি নয়। অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠল তারা। পুরুষানুক্রমে যেসব জমির স্বত্ব তাদের ছিল, যেসব জমিতে এতদিন ফসল ফলিয়ে এসেছে তারা, সেই জমি কিছুতেই হারাতে রাজি নয়। শুরু হলো বিদ্রোহ।
বাঁকুড়ার দক্ষিণ দিক থেকে বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুরের সমগ্র পশ্চিমাঞ্চলে ব্যাপকভাবে শুরু হল চুয়াড় ও পাইক বিদ্রোহ। ইতিহাসে ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে এই চুয়াড় বিদ্রোহ ছিল অত্যন্ত ভয়ানক, ভয়ংকর। ১৮০৬ সালে বগড়ী অঞ্চলে নায়েকদেরও আর এক বিদ্রোহ দেখা দিল। এই বিদ্রোহকে নায়েক বিদ্রোহ বা পাইক বিদ্রোহ বলা হয়।
অপরদিকে বিদ্রোহে সামিল হয়েছিলেন গড়বেতার গোবর্ধন দিকপতি এবং কর্ণগড়ের রাণী শিরোমনি। ইংরেজদের বিরুদ্ধে এঁরাও গর্জে উঠেছিলেন। ইংরেজরাও কঠোর হাতে এই বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা শুরু করল। পাইক চুয়াড়দের অস্ত্র ছিল তীর ধনুক এবং কিছু অস্ত্র।
শাসন শোষণ অত্যাচার অবিচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ভীষণ আকার ধারণ করে এবং সমগ্র জঙ্গলখন্ডে ছড়িয়ে পড়ে। বগড়ীর সুবিস্তীর্ণ প্রান্তরে সাহেবডাঙা নামক স্থানে ইংরেজ শিবির তৈরি হয়। বগড়ীর রাজা যাদবচন্দ্র সিংহ ইংরেজ সৈন্যদল কর্তৃক বন্দী হয়ে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে স্থানান্তরিত হন। ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে নির্দোষ এবং মুক্তিলাভ করার আগেই মারা যান তিনি। ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে যাদব পুত্র ছত্র সিংহ বগড়ীর সনদ প্রাপ্ত হন। কিন্তু তিনিও এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত আছেন এই সন্দেহে ইংরেজরা তাকেও বন্দী করে। কিন্তু ছত্র সিংহের সেনাপতি অচল সিংহ এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিতে থাকেন। অচল সিংহের সাথে যোগ দেন ভোদা, বিশা, আঠারো কাহন সর্দার যুগল ও কিশোর। দুর্বার গতিতে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। অচল সিংহ গড়বেতার নায়েক শিবিরকে কেন্দ্র করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হন। দুর্গ নির্মাণ করা হয়েছিল হুড়হুড়ি, কিশোরপুর, মালবান্দি, পাথরাশিনি, বিরাজপুর প্রভৃতি স্থানে। বহু জায়গায় ‘লায়কালিগড়’ তৈরি হয়। ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে সেনাপতি অচল সিংহের নেতৃত্বে নায়েক বিদ্রোহ আরও তীব্র আকার ধারণ করে। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে মিঃ চার্লস রিচার্ড ও মিঃ হেনরি এই দুজন ইংরেজ সেনাধ্যক্ষের অধীনে অশ্বারোহী গোরা সৈন্য বিদ্রোহ দমনের জন্য বগড়ীতে আসেন। সম্মুখ সমরে ইংরেজ সৈন্যদের কাছে নায়েক বীরগণ পরাজিত হলে বিজয়ী ইংরেজ সৈন্য গড়বেতার নায়েক শিবির ভস্মীভূত করে দেয় আর ফাঁসিডাঙায় নিয়ে এসে বিদ্রোহীদের গাছে গাছে ঝুলিয়ে দেয়। যুগল ও কিশোর দুই ভাই ধরা পড়েন। কেশপুর থানার অন্তর্গত শ্যামচাঁদপুর অঞ্চলের প্রতিষ্ঠাতা নিত্যানন্দ সিংহ তখন চন্দ্রকোণা ও বগড়ী অঞ্চলের দারোগা ছিলেন। ইনিই ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে ফাঁসিডাঙায় এই দুই ভাইয়ের ফাঁসি দিয়েছিলেন। এদের ফাঁসির সময় কাঠ ডমুকের বাজনা বাজানো হয়েছিল অর্থাৎ ঢাক ঢোল বাজিয়ে ব্রিটিশ সরকার এদের ফাঁসি দিয়ে নিজেদের বীরত্ব জাহির করেছিল। হাবল রাজেন্দ্র ফাগু ও সুবল প্রভৃতি নেতৃস্থানীয় বীরদের ফাঁসি এই ফাঁসি ডাঙাতেই হয়েছিল।
ইংরেজরা বগড়ীর রাজা ছত্র সিংহের জমিদারি কেড়ে নিয়ে পাঠকদের সঙ্গে তাঁর যোগসাজশ থাকার সন্দেহে তাকে কারারুদ্ধ করে রাখে। দফায় দফায় তাকে হুগলীর চুঁচুড়ায় এবং মেদিনীপুরে রাখা হয়। সেনাপতি অচল সিংহ বীর বিক্রমে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকে।
কিন্তু ইংরেজদের প্রলোভনে ছত্র সিংহ তার পৈতৃক রাজ্য ফিরে পাবার আশায় এক অদ্ভুত কান্ড করে বসলেন। ইংরেজ শাসকদের তুষ্ট করতে গিয়ে তিনি কৌশলে সেনাপতি অচল সিংহ কে ষড়যন্ত্র করে ধরিয়ে দেন। ইংরেজরা পাইকদের এই দুর্ধর্ষ নেতাকে পেয়ে তাকে বন্দী করে বিচারের ব্যবস্থা করে তাঁর ফাঁসির ব্যবস্থা করে। অচল সিংহ সহ আরো ৩০ জন যোদ্ধার কোম্পানির বিচারে মেদিনীপুরের পুরাতন জেলখানা মাঠে [ মারাঠা দুর্গ ] র সংলগ্ন মাঠে প্রকাশ্যভাবে ফাঁসি দেয়া হয়।
ফাঁসিডাঙার শাল পিয়াল বট পাকুড়ের বড় বড় ডালে ডালে বীর চুয়াড় পাইকদের ধরে ধরে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হতে লাগল। বীভৎস সেই ফাঁসিকাঠে লটকে থাকা দেহগুলো দেখে লোকে শিউরে উঠতো। ভবিষ্যতে যাতে কেউ এরকম বিদ্রোহ না করতে পারে ইংরেজ শাসকরা বিদ্রোহীদের এভাবে ফাঁসিতে লটকে সকলের কাছে এই দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চেয়েছিল।
পরে এই স্থানের নাম হয় ফাঁসিডাঙা। সেই ঘন জঙ্গল আর নেই। নেই শাল পিয়াল বট পাকুড়ের গাছ। তবে বেশ কয়েকবছর আগেও এখানে একটি বিশাল বট গাছ ছিল বলে অনেকে বলে থাকেন। পরবর্তী কালে এই জায়গায় ফাঁসির মঞ্চের আকারে একটি প্রতীকী মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল। আরও পরবর্তী কালে এই ঐতিহাসিক জায়গাটি স্মরণীয় করে রাখার জন্য এবং সকলের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে একটি বিশাল আকারের ফাঁসির মঞ্চ স্মারক তৈরি করে রাখা হয়েছে। নবকলেবরে সেজে উঠেছে ফাঁসিডাঙা। পর্যটকদের কাছে এখন এটি একটি দর্শনীয় স্থান। ২০২১ সালে পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রশ্মি কমল আনুষ্ঠানিকভাবে এটি পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। এখানে টিকিট কেটে এখন এই ঐতিহাসিক স্থানে প্রবেশ করতে হয়।