প্রদ্যোৎ কুমার ভট্টাচার্যের অভিন্ন হৃদয় বন্ধু প্রভাংশুশেখর পাল ছিলেন একজন দৃঢ়চেতা বিপ্লবী। জীবন মৃত্যুকে সত্যিই পায়ের ভৃত্য করে যিনি মাত্র ৪ ফুট দূরত্বে দাঁড়িয়ে ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেটকে গুলিবিদ্ধ করার স্পর্ধা দেখিয়েছিলেন। যেখানে ধরা পড়ার অর্থ নিশ্চিত মৃত্যু তা জেনেই তিনি অগ্রসর হয়েছিলেন। শুধুমাত্র দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের জন্য যিনি যুদ্ধক্ষেত্রে সম্মুখ সমরে অভূতপূর্ব বীরত্ব প্রদর্শন করে অক্ষত দেহে ব্রিটিশ সিংহের চোখে ধুলো দিয়ে ফিরে এসেছেন তিনি আর কেউ নন। দাসপুর থানার আর এক বীর বিপ্লবী প্রভাংশুশেখর পাল। স্বাধীন ভারতের প্রতিটি তরুণের কাছে তিনি চির নমস্য। বস্তুত প্রভাংশুশেখরের বিপ্লবী জীবনের অধিকাংশ ঘটনা ছিল প্রদ্যোতের জীবনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
প্রভাংশুশেখরের পৈত্রিক বাসস্থান ছিল মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল মহকুমার অন্তর্গত দাসপুর থানার খাঞ্জাপুর গ্রামে। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই জুলাই প্রভাংশুশেখর উড়িষ্যার পুরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন ডাক্তার আশুতোষ পাল। তিনি ফাইলেরিয়া রোগ নিরাময়ের ঔষধ আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁর মাতা ছিলেন লক্ষ্মীমণি দেবী। তাঁর মাতা শুধু শিক্ষিতাই ছিলেন না সাহসী মহিলাও ছিলেন। প্রভাংশুশেখরের বিপ্লবী হওয়ার পেছনে তার মাতা ঠাকুরানীর সম্মতি ছিল। তিনি প্রভাংশুশেখরের বিপ্লবী বন্ধুদের নানাভাবে সাহায্যও করেছিলেন।
প্রভাংশুশেখর মেদিনীপুরে মামাবাড়িতে পড়াশোনার জন্য আসেন এবং মামা কৃষ্ণচন্দ্র বসু তাঁকে মেদিনীপুরের হিন্দু স্কুলে ভর্তি করে দেন। এই স্কুলে পড়ার সময়তেই তিনি সহপাঠী ফনীন্দ্র কুমার দাসের সাহায্যে বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স নামক বিপ্লবী দলের সংস্পর্শে আসেন। প্রভাংশুর পেটাই চেহারা, তীক্ষ্ণ-বুদ্ধি, দুর্জয় মনোবল এবং অপরিসীম সাহস অচিরেই বিপ্লবী নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। গুপ্ত সমিতির জন্য তিনি নানাভাবে অর্থ সংগ্রহ করেন এমনকি মায়ের অলংকার বিক্রি করতেও ইতস্তত বোধ করেননি। এমনই ছিল তার দুর্জয় সাহস এবং সংকল্প।
মেদিনীপুরে জেলায় নিযুক্ত জেলা শাসক পেডি ছিলেন অত্যন্ত অত্যাচারী৷ ১৯৩১ এর ৭ ই এপ্রিল বি.ভি.র সদস্য বিমল দাসগুপ্ত তাকে হত্যা করলে মেদিনীপুরে অত্যাচারের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। ওই বছরই ১৭ই সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে নটা নাগাদ হিজলী জেলে বন্দী নিবাসে ৫০ জন বন্দুকধারী পুলিশ ও ২৫ জন লাঠি ও বেয়নেটধারী পুলিশ প্রবেশ করে নিরীহ বন্দীদের ওপর গুলি চালালো। নিহত হলেন সন্তোষ কুমার মিত্র ও তারকেশ্বর সেনগুপ্ত। আহত হলেন অনেকে। এই গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন পরবর্তী জেলাশাসক চার্লস ডগলাস। কলকাতার বি.ভি কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে নির্দেশ এলো অত্যাচারী ডগলাসকে হত্যা করতে হবে। দায়িত্ব পড়ল প্রভাংশু এবং প্রদ্যোৎ এর ওপর।
১৯৩২ সালের ৩০ শে এপ্রিল জেলাশাসক ডগলাস মূলত প্রভাংশুর বন্দুকের ৫টি গুলিতে বিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। প্রদ্যোতের বন্দুক সেদিন অকেজো ছিল যা শেষ পর্যন্ত প্রদ্যোতের মৃত্যু ডেকে এনেছিল। সেদিন প্রভাংশু নিজের উপস্থিত বুদ্ধি এবং দুর্জয় সাহস দেখিয়ে ব্রিটিশের চোখে ধুলো দিয়ে অক্ষত শরীরে ফিরে আসতে পেরেছিলেন। বিপদমুক্ত প্রভাংশুশেখর ছদ্মবেশের গোঁফজোড়াটি খুলে ফেললেন। তারপর নাড়াজোল রাজ কাছারির উত্তর দিকে লালদীঘিতে পৌঁছে পায়ের কেটস এবং কাগজপত্র জলে ফেলে দিলেন। এরপর মানিকপুরের রাস্তা ধরে কিছুটা গিয়ে একটি ক্যালভার্টের নিচে রিভলবার ও বুলেট মাটিচাপা দিলেন। মানিকপুরে পৌঁছে ব্রজ কিশোরকে দেখতে পেয়ে তাকে রিভলবারের কথা জানিয়ে দ্রুত মামাবাড়িতে পৌঁছলেন। সেখানে হাফসার্টটি ছিড়ে ফেললেন এবং স্নান টান সেরে বাড়ির লোকজনদের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই গল্পগুজব শুরু করে দিলেন। কাউকে ঘুনাক্ষরেও জানতে দিলেন না যে তিনি কত বড় অ্যাকশন করে এসেছেন।
আরেক মামা অমল চন্দ্র বসু রাত্রি আটটা নাগাদ বাড়ির লোকেদের জানালেন যে, দুটি বিপ্লবী ছেলে ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাসকে গুলি করেছে। একজন ধরা পড়েছে। তার নাম প্রদোৎ কুমার ভট্টাচার্য। অন্যজন পালিয়ে গেছে। সিপাহীরা তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। রাত্রি দশটায় খবর এলো ডগলাস মারা গেছে। ডগলাসের মৃত্যু সংবাদে প্রভাংশুশেখর খুশি হলেও প্রদ্যোতের জন্য তাঁর মন অস্থির হয়ে উঠলো। আর কেবলই মনে হল পুলিশ তাকেও ধরতে বাড়িতে ছুটে আসবে। অমল বাবু ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ মানুষ। তিনি পরিস্থিতির গভীরতা উপলব্ধি করতে পেরে প্রভাংশুশেখরকে বোন নীলিমার সঙ্গে দ্রুত কলকাতা পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। পরদিনই কৃষ্ণচন্দ্র বসু মেদিনীপুর থেকে এলেন অমল বাবুর বার্তা নিয়ে। পুলিশ প্রভাংশুশেখরকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে যেন বলে যে ২৯ এপ্রিল সে তার বোন নীলিমাকে আনার জন্য মেদিনীপুর গিয়েছিল। ৩০শে এপ্রিল দুপুর তিনটার ট্রেনে বোনকে নিয়ে ফিরে এসেছে। ডগলাস হত্যার সময় সে মেদিনীপুর শহরেই ছিল না।।
অমল বাবুর চেষ্টার ত্রুটি না থাকলেও শেষ রক্ষা হয়নি। প্রদ্যোতের স্বীকারোক্তিতে সিতাংশুশেখরের নাম ছিল। পুলিশ ভেবেছিল প্রভাংশুর ভাই সিতাংশুশেখর এতই ছোট যে প্রদ্যোত প্রভাংশুশেখরের নাম গোপন করার জন্য সিতাংশুশেখরের নাম বলেছে। 11ই মে ১৯৩২ পুলিশ প্রভাংশুকে কলকাতা থেকে গ্রেফতার করে এবং সেই দিনেই মেদিনীপুরে আটক করে নিয়ে যায়। কিন্তু সব রকম চেষ্টা সত্ত্বেও পুলিশ প্রভাংশুশেখর কে আসামি হিসাবে সনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট প্রভাংশুকে মুক্ত করে দেন।
প্রভাংশু কিন্তু এখানেই থেমে থাকেলেন না। ডগলাস নিধনের পর মিস্টার বার্জ মেদিনীপুরের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে এলেন। তখন প্রভাংশুদের লক্ষ্য হয়ে উঠলেন মিস্টার বার্জ। বৃটিশের চোখ এড়ানোর জন্য প্রভাংশু কলকাতায় থেকেই দলের যাবতীয় কাজ করতেন। ১৯৩২ সালের ২রা সেপ্টেম্বর অনাথ বন্ধু ও মৃগেন্দ্র মেদিনীপুরের পুলিশ গ্রাউন্ডে মিস্টার বার্জকে গুলি করে হত্যা করেন। ব্যাকগ্রাউন্ডে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন প্রভাংশু। পরপর ডগলাস এবং বার্জ হত্যার পর প্রভাংশুশেখর এর উপর পুলিশের আক্রোশ দ্বিগুণ বেড়ে যায়। ১৯৩৩ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর পুলিশ প্রভাংশু কে গ্রেফতার করে। এই সময় তাঁর তীব্র জ্বর এবং পায়ে ভীষণ যন্ত্রণা হলেও কারাগারে কোন ঔষধপত্র কিছুই দেওয়া হয়নি। শুধু তাই নয় বি ভি দলের কথা বার করার জন্য মারধর, নখে পেরেক ফোটানো প্রভৃতি অকথ্য অত্যাচার তার উপর করা হয়। তারপর বি সি এল এ আ্যক্টে তাঁকে প্রেসিডেন্সি জেলে বিনা বিচারে দীর্ঘদিন বন্দী করে রাখা হয়। ১৯৩৮ সালে প্রভাংশু শেখর সাময়িকভাবে মুক্তি লাভ করেন। কিন্তু তার নির্যাতন এখানেই শেষ হয়নি। ১৯৪১ সালের জানুয়ারিতে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু নজরবন্দী অবস্থায় ব্রিটিশের চোখে ধুলো দিয়ে ভারতের বাইরে মহাপ্রস্থান করেন। তখন আবার শুরু হয় বি ভি সদস্যদের ধরপাকড়। যথারীতি প্রভাংশুশেখরকেও আটক করা হয়। গৃহে অন্তরীণ থাকার সময় প্রভাংশুশেখরের পড়াশোনা কিন্তু অব্যাহত ছিল। প্রথমে আই এ পাশ করেন। 1941 সালে তিনি বি কম পাস করেন। তারপর হোমিওপ্যাথি নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং শেষপর্যন্ত ডাক্তারি প্র্যাকটিস করে সংসারের পুরো দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ভাই বোনদের ও যথাযথভাবে মানুষ করেন।
প্রভাংশুশেখর সংসারে থাকলেও তিনি আজীবন সন্ন্যাসীর জীবন পালন করেছিলেন। স্বাধীনতার পরে নানা জনহিতকর কাজে এবং দেশসেবায় নিজেকে প্রতিনিয়ত যুক্ত রেখেছিলেন। পাঁচের দশকে তিনি মেদিনীপুর সম্মিলনীর সম্পাদক হিসাবে মেদিনীপুরের অনেক গরিব মেধাবী ছাত্রদের কলকাতায় পড়াশোনা করার জন্য নানাভাবে সাহায্য করেছেন। ডাক্তার বীরেশ্বর গুহ রোডে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের যে বিপ্লবী নিকেতন গড়ে উঠেছিল সেটি পরবর্তীকালে রণবীর মুখোপাধ্যায়ের আই কেয়ার এন্ড রিসার্চ সেন্টারে রূপান্তরিত হয়। দেশ সেবাই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত।
কিন্তু তিরিশ এর সেই মহা বিপ্লবী প্রভাংশু শেখর ৯০ এর দশকে আধ্যাত্মিক ভাবে মগ্ন হন। তাঁর মনের মধ্যে বারবার প্রশ্ন জাগতো সবই কি ঈশ্বরের নির্দেশিত পথে ঘটছে? তাঁর গুলিতে ডগলাসের মৃত্যু হল। ফাঁসি হলো প্রদ্যোতের। পালানোর সময় প্রহরীরা এলোপাথাড়ি গুলি বর্ষণ করল কিন্তু একটি গুলিও তাঁর দেহ স্পর্শ করল না। প্যারেড গ্রাউন্ডে সনাক্তকরণের সময় যাঁরা সনাক্ত করতে এসেছিলেন তারা কেউই তাকে চিনতে পারলেন না এসব কী করে সম্ভব! এর পিছনে কি কোন অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ কর্তার হাত আছে? জীবনের শেষ প্রান্তে প্রভাংশু শেখর প্রদ্যোতের জন্মস্থানে এসেছিলেন। তাঁর বন্ধুর প্রয়াণে তিনি যন্ত্রণা ও দুঃখ আজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন। ১৯৭২ সালে ১৫ ই আগস্ট ভারত সরকার তাকে তাম্র ফলক প্রদান করে সম্মানিত করেন।
প্রভাংশুশেখর ২০০৭ সালের ২রা জুন সন্ধে ৭ঃ৫০ মিনিটে প্রয়াত হন। তিনি কেবলমাত্র বিপ্লবী নন, মানবিকতার বিরল দৃষ্টান্ত। অনেক বিপ্লবীর স্বাধীনতার পরেও পদস্খলন ঘটেছে কিন্তু প্রভাংশু শেখর ছিলেন সম্পূর্ণই ব্যতিক্রমী। বিপ্লবী প্রভাংশু এবং শহীদ প্রদ্যোৎ কুমার সর্বকালের সর্বযুগে ভারতের আপামর নাগরিকের নমস্য ব্যক্তিত্ব।
বীরের এ রক্ত স্রোত,
মাতার এ অশ্রুধারা
এর যত মূল্য সে কি ধরার
ধূলায় হবে হারা।
স্বর্গ কি হবেনা কেনা,
বিশ্বের ভান্ডারী শুধিবে না
এত ঋণ?