অগ্নিযুগে বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রিয় বিচরণ ভূমি ছিল মেদিনীপুর জেলা। খ্যাত-অখ্যাত বহু বীর শহীদের জন্ম দিয়েছে মেদিনীপুর। এই জেলা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। হঠাৎ করে মেদিনীপুর জেলার মানুষ দেশপ্রেমিক, স্বাধীনতাকামী হয়ে ওঠেনি- এ তার উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ। দুরাচারী শাসকের বিরোধিতায়, পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনে সর্বস্ব ত্যাগ করেছেন মেদিনীপুর জেলার বীরেরা, প্রয়োজনে দেশের জন্য আত্মোৎসর্গ করে শহীদ হয়েছেন। স্বৈরাচারী শাসকের ক্ষমতার প্রাবল্যে নিপীড়ন, গণহত্যা এবং নিষ্ঠুর অত্যাচার মাঝে মধ্যে এখানকার মানুষের বিদ্রোহকে স্তিমিত করে দিলেও আবার তা স্বমহিমায় আত্মপ্রকাশ করেছে। গণজাগরণের ঢেউ জেলা থেকে জেলান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। বহু শত বর্ষ ধরে মেদিনীপুরের রাঙা মাটি শত শত শহীদের রক্তে আরও রক্তিম হয়ে উঠেছে। মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল মহকুমাও একই গৌরবে গৌরবান্বিত।
ইতিহাস আমাদের জানিয়েছে মেদিনীপুর জেলার উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাংশে এক সময়ে বহু স্বাধীন রাজা, জমিদার, ক্ষুদ্র জমিদার বসবাস করতেন। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার-উদ্দিন-বখতিয়ার-খিলজি লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করে লক্ষ্মণাবতী তথা নদীয়া জয় করেন। কিন্তু মেদিনীপুর জেলায় পরবর্তী একশো বছরেও মুসলমান আধিপত্য স্থাপিত হয়নি। এখানকার স্বাধীন নৃপতিবর্গ প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। ১৫৭২ খ্রিস্টাব্দে রাজমহলের মোঘল পাঠান যুদ্ধে পাঠানরা পরাজিত হলে সারা বাংলায় মোঘল আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ‘বাহার-ঈস্তান-ঈ-গায়বি ’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় সম্রাট জাহাঙ্গীরের (১৬০৫ খ্রিঃ – ১৬২৬ খ্রিঃ) আমলে বিদ্রোহী স্বাধীনচেতা রাজাদের মধ্যে চন্দ্রকোণার বীর ভান, চন্দ্র ভান এবং বরদার জমিদার দলপতও ছিলেন।
দিল্লির তখতে তাউসে তখন শ্রেষ্ঠ সেনাপতি সম্রাট ঔরঙ্গজেব (১৬৫৮খ্রিঃ-১৭০৭ খ্রিঃ)। তাঁর প্রিয়ভাজন বর্ধমান রাজ কৃষ্ণরাম রায়। বরদার ক্ষুদ্র জমিদার শোভা সিংহ মোঘল সম্রাটকে খাজনা দেওয়া বন্ধ করে সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। কেবল তাই নয় ১৬৯৫ খ্রিস্টাব্দে সসৈন্যে কৃষ্ণরামের রাজধানী আক্রমণ করেন এবং তাঁকে হত্যা করে নিজেকে বর্ধমান অধিপতি রূপে ঘোষণা করলেন। ১৬৯৫ খ্রিষ্টাব্দেই বর্ধমানে শোভা সিংহের রহস্যময় মৃত্যু হয়। রাজ্যচ্যুত শোভা সিংহের কাকা মহা সিংহ বিদ্রোহের ধারা অব্যাহত রাখেন। ১৭০২ খ্রিস্টাব্দে ‘মহাবালা’ প্রান্তরে বরদা ও চন্দ্রকোণার মিলিত সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে মোঘল মদত পুষ্ট বর্ধমান রাজের সৈন্যবাহিনীর যুদ্ধ হয়। পরাজিত বরদা গড়কে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয় বর্ধমান সৈন্য।
বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব আলিবর্দী খাঁ এর মৃত্যু ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে ৯ই মার্চ। তাঁর দত্তক নেওয়া দৌহিত্র সিরাজদ্দউলা বাংলার নবাব হলেন। কন্যা আমেনা এবং জামাতা জইনুদ্দিনের পুত্র সিরাজকে তিনি উত্তরাধিকারী মনোনীত করে গিয়েছিলেন। সিংহাসনে বসার পরে পরেই মীর জাফর , মহতাপ চাঁদ ওরফে জগৎ শেঠ, উমি চাঁদ, মানিক চাঁদ, রায় দুর্লভ প্রমুখ তাঁকে সিংহাসন চ্যুত করার চক্রান্তে ইংরেজদের সঙ্গে যোগ দেন। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ শে জুন পলাশীর প্রান্তে নবাব সিরাজদ্দউলার সঙ্গে ইংরেজ সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভের যে যুদ্ধ হয় তাতে সিরাজদ্দউলার পরাজয় ঘটে। ষড়যন্ত্রীর দল জিতে গেল। বাংলার মসনদে বসলেন মীর জাফর। পরে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির পছন্দমতো নবাব হলেন মীর কাসিম।
বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব মীর কাসিমের (১৭৬০খ্রিঃ-১৭৬৩খ্রিঃ) আমলে গভর্নর ভ্যান্সিটার্টের শর্তানুসারে মেদিনীপুর, বগড়ি, বর্ধমানের কর আদায়ের ক্ষমতা পায় ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি।মেদিনীপুর জেলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এক সময়ে জঙ্গলাকীর্ণ ছিল। এখানকার লাল কাঁকুরে মাটিতে ফসল ফলানো খুব কষ্টকর। তাই জমির খাজনা ছিল নাম মাত্র। আর খাজনা আদায়ের জুলুম ছিল না বললেই চলে। এইসব এলাকায় উপজাতির বসবাস। ‘মেদিনীপুর’ নামক গ্রন্থে তরুণদেব ভট্টাচার্য লিখেছেন, “জমিদারদের পাইক বরকন্দাজেরা ছিল বেশির ভাগই নানা উপজাতির লোক। যথা ভঞ্জ, কুর্মালি, কোড়া , মুণ্ডারি, কুর্মি, বাগদী, মাঝি, লোধা, ইত্যাদি ।” স্থানীয় জমিদারেরা জমিদারির আভ্যন্তরীণ শাসন পরিচালনা করতে এবং যুদ্ধ প্রতিরোধ ও যুদ্ধ করার জন্য বেশ কিছু সর্দারের অধীনে পাইক রাখতেন। এই পাইকরা নিজস্ব তীর ধনু ঢাল তরোয়াল বল্লম সড়কি লাঠি বন্দুক নিয়ে দেশের শান্তি রক্ষা করত এবং প্রয়োজনে যুদ্ধের সময় জমিদারকে সাহায্য করত। বিনিময়ে বিনা খাজনায় জমি ভোগদখল করত পুরুষানুক্রমে। ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি খাজনা আদায়ের অধিকার পেয়ে এই সব নিষ্কর জমিতে খাজনা বসাতে শুরু করে খাজনার হার বৃদ্ধি করে। ক্রমে অসন্তোষ বাড়তে থাকে পাইকদের মধ্যে।
১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে মোঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ আলমের কাছ থেকে চুক্তি বলে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার দেয়ানি লাভ করে। আভ্যন্তরীণ শাসন ও শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পেল ইংরেজরা। কাজ হারাল সমস্ত পাইক। ধূমায়িত অসন্তোষে ঘৃতাহুতি পড়ল। তাদের নিষ্কর জমিতে বসল কর। বিক্ষুব্ধ পাইকরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুরের সন্ন্যাসী এবং ফকিররা বিদ্রোহী হয়। ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড একদল গোরা সৈন্য নিয়ে ক্ষীরপাইয়ে বিদ্রোহ দমন করতে আসেন। ক্ষীরপাইয়ের কাছে সন্ন্যাসীদের সঙ্গে যুদ্ধ হয়। সন্ন্যাসীদের নেতা ছিলেন স্বামী শিবানন্দ। ‘পৃথিবীর ইতিহাস’ রচয়িতা দুর্গাদাস লাহিড়ীর মতে স্বামী শিবানন্দ মস্তারাম বাবাজি নামে হাওড়াতে আত্মগোপন করেছিলেন। শিবানন্দের কৌশলের কাছে পরাজিত হয়ে ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড ফিরে যান। এই ঘটনা ইতিহাসে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হল। সমস্ত জমিদারি কোম্পানির অধীন এলে খাস জমিতেও কর বসল। জমিদাররা বিদ্রোহী হলেন। কর্ণগড়ের রানি শিরোমণি, রাইপুরের রাজা দুর্জন সিংহ, বগড়ির জমিদার যদু সিংহ, দাসপুরের উত্তর ধানখালের গোবর্ধন দিকপতি প্রমুখেরা নেতৃত্ব দেন পাইক বিদ্রোহীদের। ১৭৯৮- ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের এই বিদ্রোহ ইতিহাসে পাইক বিদ্রোহ বা চুয়াড় বিদ্রোহ নামে পরিচিত। কর্নেল ওকেলির নেতৃত্বে সৈন্য বাহিনী গনগনির মাঠে বিদ্রোহীদের পরাজিত করে এবং দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করার জন্য যুদ্ধ বন্দিদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখে। দাসপুরের গোবর্ধন দিকপতির ফাঁসি হয়। যদু সিংহের সেনাপতি অচল সিংহ সাঁওতাল শবর লোধা বাউরিদের সংগঠিত করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। কঠোর হস্তে ইংরেজ সরকার এই বিদ্রোহ দমন করে। এই বিদ্রোহ নায়েক বিদ্রোহ বলে ইতিহাসে খ্যাত। ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ সরকার যুগল ও কিশোর নামে দুই বিদ্রোহীকে ফাঁসি দেয় চন্দ্রকোণার কাছে ফাঁসি ডাঙার মাঠে। নায়েক বিদ্রোহের সমাপ্তি ঘটে।
১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ২৮ শে ডিসেম্বর দাদা ভাই নওরোজি, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, অক্টোভিয়ান হিউম প্রমুখের নেতৃত্বে কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা হল। ভারতের মানুষ কংগ্রেসের পতাকা তলে সমবেত হয়ে ইংরেজদের কুশাসনের প্রতিবাদ করতে শুরু করল। ১৯০১ খ্রিঃ । মেদিনীপুরে বার্জ টাউনে কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলন হয়। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় উপস্থিত থেকে কংগ্রেস সদস্যদের উৎসাহিত করেন। ১৯০২ খ্রিঃ মেদিনীপুরে এলেন অরবিন্দ ঘোষ, হেমচন্দ্র কানুনগো, জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু , সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ। ১৯০৩ খ্রিঃ এলেন ভগিনী নিবেদিতা। মৌলবি আবদুল কাদেরের বাড়িতে একটি ব্যায়ামাগারের উদ্বোধন করলেন নিবেদিতা। এই ব্যায়ামাগারগুলি ছিল বিপ্লবীদের আঁতুড় ঘর। ঘাটালের রামজীবনপুর সহ অন্যত্র বহু কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছিল।
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হল। প্রতিবাদে সারা ঘাটাল মহকুমায় কারো বাড়িতে রান্না হয়নি। ঘাটাল, ক্ষীরপাই প্রভৃতি স্থানে সভা হয়। ঘাটাল মহকুমার মানুষ অশৌচ পালন করে। বিপ্লবী শহিদ ক্ষুদিরাম বসুর দিদি বাড়ি দাসপুর থানার হাটগেছিয়ায়। দাসপুরের সঙ্গে ক্ষুদিরামের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ক্ষুদিরাম হ্যামিল্টন স্কুলে পড়ার সময় তাঁর সহপাঠী ছিলেন চাঁদপুরের গৌরীশংকর সেন। গৌরীশংকরের দাদা আলিপুর বোমা মামলার আসামী পূর্ণচন্দ্র সেন ক্ষুদিরামকে মেদিনীপুরে হেমচন্দ্র কানুনগো সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রভৃতি বিপ্লবীদের সঙ্গে পরিচিত করেন। ১৯০৬ খ্রিঃ ফেব্রুয়ারি মাসে মেদিনীপুরে কৃষি শিল্প প্রদর্শনীর মেলায় ক্ষুদিরাম বসু ‘সোনার বাংলা’ নামে ইস্তাহার বিলির অপরাধে গ্রেফতার হন। অবশ্য বিচারে তিনি ছাড়া পেয়ে যান। এই বছরের মার্চ মাসে জাড়ায় দুটি সভা হয়। এই সভায় জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়েছিলেন বরিশাল থাকে আসা বিপ্লবী চন্দ্রকান্ত চক্রবর্তী এবং কলকাতা থেকে আগত কার্তিকচন্দ্র বর্মনদাস। এই সভার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন জাড়ার কিশোরীপতি রায়। বিদেশী জিনিস বর্জন করে স্বদেশী দ্রব্যের ব্যবহার বাড়ে এই সভার পরে।
১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে দিদি অপরূপা ও ভগ্নীপতি অমৃতলাল রায়ের সঙ্গে ক্ষুদিরাম হাটগেছিয়াতে এলেন। বিপ্লবীদের টাকার বড় প্রয়োজন। ক্ষুদিরামের ইচ্ছে টাকা দেয়। নিঃস্ব ক্ষুদিরাম এক দুঃসাহসিক কাজ করলেন। দিদি বাড়ি সংলগ্ন গ্রাম সিমলার দিঘির পাড়ে ডাক লুন্ঠন করেন ক্ষুদিরাম। লুণ্ঠিত অর্থ মঙ্গল সাঁতরা মারফৎ মেদিনীপুরে বিপ্লবীদের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করে রণপা যোগে রাতারাতি গোপীগঞ্জে পৌঁছে যান। এখান থেকে লঞ্চে করে কোলাঘাট, সেখান থেকে ট্রেনে নিরাপদে মেদিনীপুরে চলে যান। জীবদ্দশায় আর কোনদিন হাটগেছিয়ায় আসেননি তিনি।
এই জেলার বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করার জন্য কার্জনকে জেলা দু’টুকরো করার পরামর্শ দিলেন ফ্রেজার। সেই ফ্রেজারকে হত্যা করার জন্য নারায়ণগড় স্টেশনের কাছে ডহরপুরে রেললাইনে মাইন পাতে বিপ্লবীরা। তারিখ ছিল ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের ৬ই ডিসেম্বর। মাইন যথা সময়ে ফাটেনি। সারা ভারতে এটি ছিল বিপ্লবীদের প্রথম মাইন বিস্কোরণ। কলকাতার চিপ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ কিংসফোর্ড সুযোগ পেলে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের তুচ্ছ কারণে গুরুদণ্ড দিতেন। বন্দেমাতরম পত্রিকার বিরুদ্ধে লালবাজার পুলিশ কোর্টে বিচার দেখতে আসা চোদ্দ বছরের সুশীল সেনকে সামান্য অপরাধে কিংসফোর্ড পনেরো ঘা বেত মারার নির্দেশ দেন। গুপ্ত সমিতির গোপন সভায় রাজা সুবোধ মল্লিক, অরবিন্দ ঘোষ, চারুচন্দ্র দত্ত কিংসফোর্ডের প্রাণদণ্ড বহাল করেন। বিপ্লবীরা কিংসফোর্ডকে হত্যা করার জন্য পার্সেল বোমা পাঠিয়ে ব্যর্থ হয়। কিংসফোর্ড মুজফফরপুরে বদলি হয়ে চলে গেলেন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে এপ্রিল মাসে কিংসফোর্ডকে হত্যা করার গুরু দায়িত্ব অর্পিত হয় ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকীর উপর ।
এই দুই বিপ্লবী মুজফফরপুরে মতিঝিল এলাকার কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধর্মশালায় ওঠেন। ৩০ শে এপ্রিল সন্ধে আটটার সময় কিংসফোর্ডের গাড়ি ভেবে একটি অন্য গাড়িতে বোমা ছুঁড়েন। মৃত্যু হয় ব্যারিস্টার কেনেডির স্ত্রী ও কন্যার। ওয়েনি গ্রামে ধরা পড়ে যান ক্ষুদিরাম। তাঁর কাছ থেকে পাওয়া যায় ২ টি রিভলবার, ৩৭ রাউন্ড গুলি, ৩০ টাকা , ভারতীয় রেলের ম্যাপ এবং টাইম টেবিলের একটি পাতা। প্রফুল্ল চাকী মোকামাঘাট স্টেশনে ধরা পড়ার আগে নিজের কাছে থাকা রিভলবারের গুলির সাহায্যে আত্মোৎসর্গ করেন। মুজফফরপুর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট উডম্যানের আদালতে দ্রুত বিচার হল। বিচারক মিঃ কর্নডফ মৃত্যুদণ্ড দিলেন। ক্ষুদিরামের পক্ষে উকিল কালিদাস বসু , উপেন্দ্রনাথ সেন, ক্ষেত্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, কুলকমল সেন প্রমুখ হাইকোর্টে আপিল করেন। বিচারপতিদ্বয় স্টেট ও রাইভ ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন।
ক্ষুদিরাম ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ১১ আগস্ট মঙ্গলবার ঠিক ভোর ছটায় মুজফফরপুরের জেল প্রাঙ্গণে ফাঁসিমঞ্চে মরণের ভালে জয়টীকা এঁকে দিলেন। ফাঁসিমঞ্চের পাশে উপস্থিত ছিলেন উপেন্দ্রনাথ সেন ও কালিদাস বসু। তাঁর প্রাণহীন দেহ দাহ করার জন্য জেল কর্তৃপক্ষ কালিদাস বসুর হাতে সমর্পণ করে। গণ্ডক নদীর তীরে চান্দোয়াড়া ঘাটে ক্ষুদিরামের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। বিপ্লবী বীর শহীদের শ্মশান বন্ধু ছিলেন কালিদাস বসু, উপেন্দ্রনাথ সেন, ক্ষেত্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়েরা। ওই দিন ঘাটাল বিদ্যাসাগর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক পার্বতীচরণ ঘোষের নির্দেশে ছাত্ররা খালি পায়ে জামা না পরে স্কুলে আসে। শিক্ষক মশাইরা চাদর গায়ে খালি পায়ে স্কুলে এসেছিলেন। সারা দেশের সঙ্গে ঘাটাল মহকুমাও শোকস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।
ছাপোষা সরকারি চাকুরে অমৃতলাল রায়ের সঙ্গে ক্ষুদিরামের সিমলা দিঘির পারে ডাক লুণ্ঠনের পর থেকে আর কোন যোগাযোগ ছিল না। ক্ষুদিরামের শেষ ইচ্ছা ছিল দিদি অপরূপাকে দেখার। সে ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি। ফাঁসির পর অমৃতলাল বা অপরূপা কেউ দেহ নেবার জন্য মুজফফরপুর যাননি। অপরূপা না গেলেও ক্ষুদিরামের সঙ্গে রক্তের সম্পর্কহীন মেদিনীপুরের এক স্নেহশীলা দিদি কারা প্রাচীরের পাশে উপস্থিত ছিলেন। তিনি উকিল আবদুল ওয়াজেদ সাহেবের সমাজ পরিত্যক্তা এক অসহায় বোন। সেও এক দীর্ঘ অধ্যায়।
১৯০৮ খ্রিঃ থেকে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ এই সময় কালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, বঙ্গভঙ্গ রদ ইত্যাদি কারণে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন কিছুটা নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিল। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে সারা ভারত ব্যাপী মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ‘অসহযোগ আন্দোলন’ শুরু হল। মেদিনীপুরে এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন বীরেন্দ্রনাথ শাসমল । ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের ‘বঙ্গীয় প্রাদেশিক রাষ্ট্রীয় সমিতি’র সহ সম্পাদক হলেন জাড়ার সাতকড়িপতি রায়। মেদিনীপুর জেলা কংগ্রেস কমিটির সম্পাদক হন জাড়ার কিশোরীপতি রায়। ঘাটাল মহকুমার কংগ্রেস সংগঠনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন সাতকড়িপতি রায় তাঁর সহযোগী ছিলেন দাসপুর থানার রাধাকান্তপুরের মোহিনীমোহন দাস, কলাইকুণ্ডের ভবানীরঞ্জন পাঁজা , কেঁচকাপুরের নাগেশ্বরপ্রসাদ সিংহ, রামমনোহর সিংহ ,যতীশচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ। ঘাটাল কংগ্রেস কমিটির সভাপতি ছিলেন মোহিনীমোহন দাস। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ২৪ শে ডিসেম্বর কলকাতায় এলেন যুবরাজ অষ্টম এডওয়ার্ড। অষ্টম এডওয়ার্ডের আগমন উপলক্ষে ধর্মঘট ডাকা হয়। সাতকড়িপতি রায়কে বিনা কারণে গ্রেফতার করে পুলিশ। এর প্রতিবাদে ঘাটাল দাসপুর থেকে বহু স্বেচ্ছাসেবক কলকাতায় গিয়ে কারা বরণ করেছিলেন।
১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে সাতকড়িপতি রায় বিপুল ভোটে জয়লাভ করে আইন সভার সদস্য হলেন। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বার মেদিনীপুর এলেন মহাত্মা গান্ধী। নানা স্থানে সভা করলেন। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ নির্দেশিত পল্লী সমাজ গঠন বিপুল উৎসাহে ঘাটাল ও দাসপুরে বাস্তবায়িত করা হয়েছিল। এই বছরেই শীলাবতী নদী বক্ষে নৌকোর উপর মুকুন্দ দাস স্বদেশী যাত্রা করেন। নদীর দুই পাড়ে দাঁড়িয়ে বহু মানুষ এই যাত্রা দেখে স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে মেদিনীপুরে আসেন সুভাষচন্দ্র বসু। জনজোয়ারে তাঁর সভা ভেসে গিয়েছিল। বলা বাহুল্য ঘাটাল থেকে বহু মানুষ এই সভায় যোগ দিয়েছিলেন। সুভাষচন্দ্রের আহ্বানে সারা ঘাটাল জুড়ে ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’ নামে সংগঠন গড়ে উঠেছিল। এই ডিসেম্বর মাসেই লাহোরে কংগ্রেসের যে পূর্ণ অধিবেশন হয় তাতে ঘাটালের প্রতিনিধিত্ব করেন রামমনোহর সিংহ , মোহিনীমোহন দাস। লাহোর কংগ্রেসেই ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ শে জানুয়ারিকে ভারতের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ঘাটাল মহকুমার অধিকাংশ বাড়িতে ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা উত্তোলিত হয়েছিল।
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১২ মার্চ মাসে গান্ধীজীর অসহযোগ ও লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন কংগ্রেসের কার্য নির্বাহক কমিটির দ্বারা অনুমোদিত হয়। ১২ই মার্চ লবণ আইন অমান্য করার জন্য গান্ধীজি সবরমতী থেকে ঊনআশি জন অনুগামী নিয়ে ডান্ডির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ৬ এপ্রিল আইন ভঙ্গ করে লবণ তৈরি করেন। ১৯শে মার্চ মেদিনীপুরে লবণ সত্যাগ্রহের কর্মপন্থা নিয়ে একটি সভা হয়। এই সভায় যোগ দিতে ঘাটাল থেকে মেদিনীপুর পর্যন্ত পদব্রজে ঘাটাল দাসপুরের বহু মানুষ গিয়েছিলেন। দাসপুর থানার রূপনারায়ণ নদীর তীরে শ্যামগঞ্জে লবণ তৈরির কেন্দ্র স্থাপিত হল। দাসপুর থানা কংগ্রেসের নেতৃত্ব মোহিনীমোহন মণ্ডল, মোহিনীমহন দাস ,স্বদেশরঞ্জন দাস, সুরেন্দ্রনাথ অধিকারী, যোগেন হাজরা, কাননবিহারী গোস্বামী, ভোলানাথ ঘোড়ই, হৃষীকেশ পাইন, অরবিন্দ মাইতি, বিনোদবিহারী বেরা, বিনোদ মাইতি, মন্মথকুমার মুখোপাধ্যায় প্রমুখ এগিয়ে এলেন। এঁদের সঙ্গে ছিলেন বঙ্গীয় প্রদেশ কমিটির পাঁচজন এবং ময়মনসিংহ জেলার বেশ কয়েক জন স্বেচ্ছাসেবক। ৭ই এপ্রিল শ্যামগঞ্জে লবণ তৈরির কাজকর্ম শুরু হয়। দাসপুরের শ্যামগঞ্জে লবণ তৈরি করতে থাকে স্বেচ্ছাসেবীরা। এই স্বেচ্ছাসেবীদের খাওয়া দাওয়ার জন্য বড় হাটগুলি থেকে তোলা আদায় হতো আর একই সাথে চলত পিকেটিং। স্বদেশী করা যুবকদের খাওয়ানো ও থাকার ভার নিয়েছিলেন শ্যামগঞ্জের সুরেন পালের মা গৌরী পাল। স্বদেশীদের কাছে ইনি বুড়িমা নামে পরিচিত ছিলেন। এঁর নেতৃত্বে একটি প্রমীলা বাহিনীও গড়ে উঠেছিল ।
লবণ সত্যাগ্রহকে কেন্দ্র করে সবথেকে বড় ঘটনাটি ঘটেছিল দাসপুর থানার চেঁচুয়া হাটে। ৩ জুন চেঁচুয়া হাটে অত্যাচারি দারোগা ভোলানাথ ঘোষ ছোট দারোগা অনিরুদ্ধ সামন্তকে হত্যা করে জনতা। দুটো মাস্কেট কেড়ে নেয়। পরদিন এক বিরাট পুলিশ বাহিনী এসে হাজির হয়। এলাকার পুরুষদের উপর অত্যাচার পীড়ন চলে। তখন মেদিনীপুরের ডিএম মিঃ পেডি। এডিএম আব্দুল করিম। পেডির নির্দেশে আব্দুল করিম পুলিশ ইন্সপেক্টর মিঃ লোম্যান সহ চেঁচুয়া হাটে ক্যাম্প করে ছিলেন। ৬ জুন শুক্রবার পুলিশি অত্যাচারের বিরুদ্ধে ও বন্দীদের ছেড়ে দেওয়ার দাবিতে এক বিশাল জনতা সমবেত হয়। পুলিশ গুলি চালায় ফল স্বরূপ তেমুয়ানির চন্দ্রকান্ত মান্না, শয়লার শশিভূষণ মাইতি, জালালপুরের কালীপদ শাসমল, মোহনমাইতি চকের ভৃগুরাম পাল, জোৎভগবানের দেবেন্দ্রনাথ ধাড়া, খাড়রাধাকৃষ্ণপুরের সতীশচন্দ্র মিদ্দা ও পূর্ণচন্দ্র সিংহ, জোৎশ্যামের রামচন্দ্র পাড়ই, পাঁচবেড়িয়ার নিতাইচন্দ্র পোড়্যা, বাঁশখালের অবিনাশ দিণ্ডা ও সত্য বেরা, আর মোহন মাইতি এই চোদ্দজন শহিদ হন। বহু মানুষ আহত হয়েছিলেন। প্রাণ বাঁচাতে বন্দি ও মৃতদেহ ফেলে পুলিশ ক্যাম্প ছেড়ে পালায়। দারোগা হত্যা আর পুলিশ ক্যাম্প আক্রমণ দুই ঘটনার আসামীদের স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে বিচার হয়। চূড়ান্ত বিচারে কাননবিহারী গোস্বামী, সুরেন্দ্রনাথ বাগ, যোগেন্দ্রনাথ হাজরা, শীতল ভট্টাচার্য, পার্বতীচরণ দিণ্ডা প্রমুখের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয়। মৃগেন্দ্র ভট্টাচার্য, কালাচাঁদ ঘাঁটির সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। আরও বহু জনের জেল জরিমানা হয়েছিল।
প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে এই ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১১ই জুন মেদিনীপুর জেলার পিংলা থানার সাহাড়দা গ্রামে ব্রিটিশ পুলিশ আর একটি গণহত্যা করেছিল । অসহযোগ আন্দোলন করার অপরাধে ভীমচরণ জানার বাড়িতে পুলিশ অত্যাচার করতে শুরু করে। এর প্রতিবাদে গ্রামের মানুষ সমবেত হতে থাকে। জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ গুলি চালায় । পুলিশের গুলিতে ১৫ জন শহীদ হন। শ্রী তারাশংকর ভট্টাচার্য তাঁর “ স্বাধীনতা সংগ্রামে মেদিনীপুর’ গ্রন্থে এই পনেরো জন শহীদের নাম দিয়েছেন । এঁরা হলেন সাহাড়দার ভীমচরণ জানা , ক্ষীরাইয়ের অদ্বৈত ধাড়া , অধরচন্দ্র সিং , বাবুলাল জানা , গোপীনাথ ধাড়া , নরেন্দ্রনাথ পাড়ই , নরেন্দ্রনাথ দাস, ধনঞ্জয় মণ্ডল , দণ্ডশিরার শ্রীমন্ত মাইতি। মিতিকিদার লক্ষ্মণ বেরা , রাজমার মহেশ্বর মাইতি, কুঞ্জপুরের জগন্নাথ ভক্ত, কুলতাপাড়ার কালাচাঁদ মাঝি , রাত্রাপুরের ত্রৈলোক্য গুছাইত, গোবর্ধনপুরের পূর্ণেন্দু ঘোড়ই। ক্ষীরাই গ্রামটি শহীদের গ্রাম। সম্ভবত একই গ্রামের সাত জন একই দিনে শহীদ হয়েছিলেন এমন নজির মেদিনীপুর জেলায় আর নেই।
বিপ্লবীরা এর প্রতিশোধ নিতে ভুল করেনি। ঢাকা শহরে হত্যা করে লোম্যানকে। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে ৭ এপ্রিল বিমল দাশগুপ্ত ও জ্যোতিজীবন ঘোষ গুলি করে হত্যা করেন মেদিনীপুর জেলা ম্যাজিসেট্রট মিঃ পেডিকে। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ৩০ এপ্রিল। দাসপুরের দুই বীর বিপ্লবী রাজনগরের শহিদ প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য এবং খাঞ্জাপুরের প্রভাংশুশেখর পাল হত্যা করলেন মেদিনীপুরের ডি এম মিঃ ডগলাসকে। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ২ সেপ্টেম্বর মেদিনীপুরে ডি এম মিঃ বার্জ নিহত হলেন অনাথবন্ধু পাঁজা আর মৃগেন্দ্রনাথ দত্তের ছোঁড়া গুলিতে। পর পর তিন জন ম্যাজিস্ট্রেটকে হত্যা করার ফলে মেদিনীপুর জেলা জুড়ে পুলিশ কারণে অকারণে যুবশক্তিকে জেলে ভরছিল। কিন্তু ঘাটালের স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারাকে তারা নষ্ট করে দিতে পারেনি। বরং নতুন প্রজন্ম পুরানোর সাথে যোগ দিয়ে ধারাকে পুষ্ট করে তোলে।
১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ৬ই জুন চেঁচুয়া হাটে কীভাবে শহীদ দিবস পালন করা হবে এই ব্যাপারে প্রধান উদ্যোগী ছিলেন মন্মথনাথ মুখোপাধ্যায়। তাঁর ছায়াসঙ্গী ছিলেন ধর্মদাস হড়। প্রথম বছর আসেন বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী। কংগ্রেসের পতাকা তুলেছিলন তিনি। হাজার হাজার মানুষ শহীদের শ্রদ্ধা জানাতে ভয় ভীতি উপেক্ষা করে উপস্থিত হয়েছিলেন শহীদবেদীর সামনে। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে শহীদ দিবস পালন করার অপরাধে বিনোদবিহারী সামন্ত, জানকীরঞ্জন রাজপণ্ডিত এবং রাধানাথ সামন্তকে কারারুদ্ধ করা হয়। চেঁচুয়াতে শহীদ দিবস পালনে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের অন্যতম বীর সৈনিক লোকনাথ বল, অজয় মুখার্জী, বিজয় সিংনাহার, তরুণকান্তি ঘোষ , আনন্দমোহন বিশ্বাস, অরুণ মৈত্র, নিকুঞ্জবিহারী মাইতি , ভূপতি মজুমদার প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় কংগ্রেস কমিটির সভাপতি হলেন সুভাষচন্দ্র বসু। তিনি বঙ্গীয় প্রদেশ কমিটিরও সভাপতি পদে বৃত হন। প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হয়েছিলেন নাড়াজোলের রাজা দেবেন্দ্রলাল খাঁন। প্রদেশ কমিটির সদস্য ছিলেন কেঁচকাপুরের রামমনোহর সিংহ। সুভাষচন্দ্রের পাশে বসে কমিটির বহু আলোচনা সভায় উপস্থিত থেকেছেন দেবেন্দ্রলাল ও রামমনোহর। এঁদের কাছ থেকে ঘাটাল মহকুমা সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজ নিতেন তিনি। দেবেন্দ্রলালের আগ্রহাতিশয্যে ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের ২রা মে সুভাষচন্দ্র দ্বিতীয়বার মেদিনীপুরে এলেন। লক্ষ্য ছিল ঘাটালে জনসভা করে এখানকার যুবসমাজকে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা। ২রা মে মেদিনীপুরে রাজবাড়িতে অতিথি হিসেবে রাত্রিবাস করেন। রাজ পরিবারের সদস্যদের সামনে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। ৩রা মে ঘাটালে আসাবার জন্য ট্রেন যোগে রোড চন্দ্রকোণায় নামেন। ওখান থেকে মোটর যোগে ঘাটালে আসেন।
সুভাষচন্দ্রের আগমন উপলক্ষ্যে ঘাটাল মহকুমাবাসীর পক্ষ থেকে একটি লিফলেট বিলি করা হয়েছিল। লিফলেটটি ছিল এই রকম –
“ আগামী ২০ শে বৈশাখ ইংরেজী ৩রা মে মঙ্গলবার রাষ্ট্রপতি শ্রী সুভাষচন্দ্র বসু ঘাটালে শুভাগমন করিবেন। উক্ত দিবস বেলা ৩টায় রাষ্ট্রপতি চন্দ্রকোণা রেলওয়ে স্টেশনে অবতরণ করিয়া ঘাটালের পথে বেলা ৪টায় চন্দ্রকোণা মোড়, সাড়ে চারটায় কালিকাপুর, ৫টায় রাধানগর অতিক্রম করিয়া ৫টা ৩০ মিনিটে বরদা বিশালাক্ষী মন্দিরে উপস্থিত হইবেন। অতঃপর বিরাট শোভাযাত্রা সহ রাষ্ট্রপতি ঘাটাল, কৃষ্ণনগর সভামণ্ডপে উপস্থিত হইবেন। এই মহতী জনসভায় বিভিন্ন সমিতির পক্ষ থেকে তাঁকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন ও মানপত্র প্রদান করা হইবে। এই দেশবরেণ্য নেতা ও মহামান্য অতিথিকে যথোচিত সম্বর্ধনা ও সম্মান প্রদর্শন করা ঘাটাল মহকুমাবাসী জনসাধারণের প্রধান ও অবশ্য কর্তব্য ।
এই কারণে আমাদের অনুরোধ, ঘাটাল মহকুমার জনসাধারণ উক্ত দিবসে রাষ্ট্রপতির আগমন পথ পার্শ্বস্থ গৃহ দোকানদানী পত্র পুষ্প পল্লবে ও জাতীয় পতাকায় সজ্জিত করিবেন। রাষ্ট্রপতির আগমন প্রাক্বালে পুরনারীগণ গণশঙ্খধ্বনি করিবেন এবং যথা শক্তি লাজ পুষ্প তোষণ করিবেন এবং নিজ নিজ গৃহগুলি আলোকোজ্জ্বলে সজ্জিত করিবেন ।
ইতি ১৪ই বৈশাখ ১৩৪৫ সাল।
বিনীত অভ্যর্থনা কমটির পক্ষে
আশুতোষ চৌধুরী, মোহিনীমোহন দাস, আশুতোষ সিংহ, হরনাথ দোলই, যতীশচন্দ্র ঘোষ, হরিসত্য রায়, ভবানীরঞ্জন পাঁজা, নৃপেন দাস, মনোতোষণ রায়, রামমনোহর সিংহ, লক্ষ্মণ সরকার, সুধীরপতি রায়, হরিসাধন পাইন, হৃষীকেশ পাইন। মণিকাঞ্চন বক্সী, গোবিন্দ্রচন্দ্র দাস। ”
চন্দ্রকোণা শহরে কেউ ব্রিটিশ বিরোধিতার ভয়ে সুভাষচন্দ্রকে স্বাগত জানায়নি। কালিকাপুর গ্রামে এলে সহস্রাধিক মানুষের জয়ধ্বনি তাঁকে বরণ করে নেয়। রামমনোহর সিংহের দেওয়া রুপোর থালায় করে একটি মানপত্র তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন রামজীবনপুর বাবুলাল ইনিস্টিটিউটের ছাত্র সত্যগোপাল মুখোপাধ্যায়। এই অপরাধে তাঁকে বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত করা হয়। কালিকাপুরের সেই ঐতিহাসিক স্থানে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর একটি আবক্ষ মূর্তি স্থাপিত হয়েছে। যে মানপত্রটি তুলে দেওয়া হয়েছিল সেটি ছিল অনুরূপ –
“ রাষ্ট্রপতি
শ্রীযুক্ত সুভাষ চন্দ্র বসু
শ্রদ্ধাভিন্দিতেষু
হে বরেণ্য দেশনায়ক !
নানাভাবে নির্যাতিত মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত ঘাটাল মহকুমার অধিবাসীবৃন্দ আজ তোমার সান্নিধ্য লাভ করিয়া গর্বে ও আনন্দে অভিভূত। হে বাংলার বীর মাতৃসাধক! তুমি আমাদের হৃদয়ের শ্রদ্ধাঞ্জলি গ্রহণ কর।
হে চির নিপীড়িত তরুণ বাংলার প্রাণ!
লাঞ্ছিত জাতির মর্মবেদনা শৃঙ্খলিত মানবের অন্তরের জ্বালা তোমারই দ্বারা দিকে দিকে ধ্বনিত হইয়াছে। তাই সরকারের রোষকষায়িত রক্তচক্ষু বারে বারে তোমার উপর তীব্রভাবে নিপতিত হইয়াছে, কিন্তু তোমার শৌর্য, প্রতিভা, অপরাজেয় স্বাধীন চিত্ততা, অদম্য দৃঢ়তা ও অনন্যসাধারণ তেজস্বিতার নিকট তাহা তৃণের ন্যায় ভাসিয়া গিয়াছে। শৈলাপগত নির্ঝরের মতই দুর্দ্দম বেগে পথের সমস্ত বাধা দলিয়া পিষিয়া আপনার চলার পথ রচনা করিয়া গিয়াছ। হে বীর তোমাকে নমস্কার ।
হে নির্ভীক কর্ম্মযোগীন !
নিখিল ভারতের রাষ্ট্রক্ষেত্রে বাংলার ত্যাগ ও সাধনা যখন উপেক্ষিত ও অস্বীকৃত, তখন তুমিই অকম্পিত কণ্ঠে অবমাননার প্রতিকার চাহিয়াছিলে। তরুণ বাংলা আজো মুগ্ধ চিত্তে তাহা স্মরণ করে। হে দুঃখব্রতী সাধক! সে দুঃখের মন্থন বেগে আজ যে অমৃত উত্থিত হইয়াছে, তাহা যোগ্য পাত্রেই অর্পিত হইয়াছে। হে রাষ্ট্রপতি সুভাষ চন্দ্র! সমগ্র বঙ্গের সাথে তুমি আমাদের শ্রদ্ধাভিবাদন গ্রহণ কর।
হে তরুণ তাপস!
জাতি যে যজ্ঞের পৌরোহিত্যে তোমাকে বরণ করিয়াছে, সে যজ্ঞে দীন রামজীবনপুরবাসীর উপকরণ সম্ভার অতি সামান্য। কিন্তু সামান্য হইলেও আমাদের সমস্ত আন্তরিকতায় তাহার অভাব ভরিয়া দিবার দুঃসাহসিকতা লইয়া তোমার সম্বর্ধনায় অগ্রসর হইয়াছি। আমাদের এক আশা তোমার শুভাগমনে আমাদের নবজাগরণ ঘটিবে, তোমার বিজয় মন্ত্র আমাদের অন্তরে নবশক্তির বোধন আনিবে। তোমার প্রদীপ্ত উৎসাহবাণী আমাদের বুকে নবপ্রেরণার নূতন অধ্যায় রচনা করিবে।
হে চিন্তাশীল মনীষী!
আজ মাত্র বঙ্গের নয়, সমগ্র ভারতের গৌরব তুমি। ভারতের বহুতর সমস্যা বহুদিক দিয়া পুঞ্জীভূত হইয়া উঠিয়াছে, আন্তর্জাতিক জগতেও নানা জটিলতর সমস্যা দেখা যাইতেছে। হে দূরদর্শী! তোমার চিন্তাধারা ভারতকে এ সকল সমস্যা হইতে আত্মরক্ষা ও আত্মপ্রতিষ্ঠার পথ প্রদর্শন করিয়া সুনিয়ন্ত্রিত ভাবে গড়িয়া তুলুক। তোমার মুক্তি সংগ্রাম দেশবাসীকে সুপরিচালিত করুক, তোমার সাধনা সফল হউক, সার্থক হউক ।
বন্দেমাতরম।
কালিকাপুর। রামজীবনপুরের অধিবাসীবৃন্দ। (ঘাটাল মহকুমার পক্ষে )
৩০ শে এপ্রিল ১৯৩৮ ।
শ্রী সরস্বতী প্রেস। কলকাতা । ”
বরদা বিশালাক্ষী মন্দির থেকে দূর্বাচটির মাঠের মঞ্চ পর্যন্ত সুভাচন্দ্র বসু পদব্রজে শত শত মানুষের অভিবাদনে অভিষিক্ত হতে হতে গিয়েছিলেন। মাঠে হাজার হাজার মানুষের বিশাল সমাবেশে তিনি উদ্দীপক ভাষণ দেন। মঞ্চে তাঁর পাশে আসীন ছিলেন ঘাটাল মহকুমার প্রথমসারির কংগ্রেস নেতৃত্ব। নাড়াজোলের রাজপরিবার ও কেঁচকাপুরের সিংহ পরিবারের কাছে নেতাজির স্মৃতি বিজড়িত বেশ কিছু অটোগ্রাফ ও নথি আছে। এগুলির সুসংরক্ষণের আশু প্রয়োজন।
নাড়াজোলের রাজবাড়ি বংশপরম্পরায় স্বাধীনচেতা। এই বংশের চুনিলাল খাঁন থেকে প্রাক্ স্বাধীনতা যুগের নরেন্দ্রলাল খাঁন, দেবেন্দ্রলাল খাঁন, রবীন্দ্রলাল খাঁন সবাই দেশপ্রেমিক ছিলেন। এই রাজ পরিবার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অকাতরে অর্থ, বল, বুদ্ধি দিয়ে সাহায্য করেছেন। রবীন্দ্রলাল দেশকে ভালোবাসার জন্য ঢাকা জেলে বেশ কয়েক বছর কাটিয়েছেন। বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু নাড়াজোলের রাজপরিবারে বেশ কিছু দিন আশ্রিত হয়ে কাটিয়েছেন। জাড়ার সাতকড়িপতি রায় নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সদস্য পদ পেয়েছিলেন। এ ছাড়া তিনি এক সময়ে প্রদেশ কংগ্রেসের সহ সভাপতিও ছিলেন। এঁর দাদা কিশোরীপতি রায় অসহযোগ আন্দোলনের সাঁইত্রিশ হাজার সদস্যের সর্বাধিনায়ক ছিলেন। ইনি ১৯৩৭খ্রিস্টাব্দে নির্বাচনে জিতে আইন সভার সদস্য হন। পাইকানদুর্যোধনের হৃষিকেশ পাইন, রাধাকান্তপুরের মোহিনীমোহন দাস, স্বদেশরঞ্জন দাস, সাহাচকের বিনোদবিহারী সামন্ত, সোনাখালির মন্মথনাথ মুখোপাধ্যায়, চন্দ্রকোণার লক্ষ্মণচন্দ্র সরকার, নাগেশ্বরপ্রসাদ সিংহ, রাধারমণ সিংহ, রামমনোহর সিংহ , কোন্নগরের হরিসাধন পাইন, মনোতোষণ রায়, গোছাতির অরবিন্দ মাইতি, কলাইকুণ্ডুর ভবানীরঞ্জন পাঁজা, শয়লার বঙ্কিমবিহারী শাসমল, ঘাটালের হরেন্দ্রনাথ দোলুই, সুরেন্দ্রনাথ অধিকারী, যতীশচন্দ্র ঘোষ, বাণেশ্বরপুরের ধর্মদাস হড়, ব্রাহ্মণবসানের মোহিনী মণ্ডল, মহারাজপুরের নিকুঞ্জবিহারী চৌধুরী, ক্ষীরপাইয়ের অন্নদাপ্রসাদ চৌধুরী, প্রমুখ কংগ্রেসের নেতারা দেশমাতৃকার পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনে যুক্ত থাকার অপরাধে কারাবাস করেছেন তবুও পথ থেকে সরে আসেননি।
স্বাধীনতা পাওয়া গেল দীর্ঘ সংগ্রাম ও বহু শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়ে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট। সারা দেশের সঙ্গে ঘাটাল মহকুমার আবালবৃদ্ধবনিতা মুক্তির আনন্দে মেতে উঠেছিল । স্বাধীনতা পাওয়ার পর দ্বীপান্তরে থাকা বন্দীরা মুক্তি পেয়েছিলেন। কারাবাসে থাকা বন্দীরা মেয়াদ শেষে দেশমাতৃকার সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন।
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আমরা প্রায় ভুলেই গেছি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সামান্য ভাতা ও তাম্রপত্র দিয়ে তাঁদের ঋণ শোধ করেছে সরকার। পাছে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের তুলনায় নিজেদের দৈন্যতা প্রকাশ হয়ে পড়ে সেই কারণে স্বাধীনতার পর থেকে যত দিন যাচ্ছে রাজনৈতিক নেতৃত্বের বড় অংশ প্রাক্ স্বাধীনতা যুগের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিষয়টি এড়িয়ে চলছেন। জনসাধারণকে বলতে চান না। স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে এঁদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে নবীন প্রজন্মের দেশপ্রেম জাগানোর জন্য তাদের কাছে এইসব শহিদের জীবনী এবং স্বার্থ ত্যাগের ইতিহাস তুলে ধরতে হবে। তবেই প্রকৃত স্বাধীনতা দিবস পালন সার্থক হবে।
গ্রন্থঋণ:
• স্বাধীনতা সংগ্রামে মেদিনীপুর # বসন্তকুমার দাস
• মেদিনীপুর # তরুণদেব ভট্টাচার্য
• মেদিনীপুরের ইতিহাস # শ্রী তারাশংকর ভট্টাচার্য
• অগ্নিযুগের দুই সৈনিক প্রদ্যোৎকুমার ভট্টাচার্য ও প্রভাংশুশেখর পাল # সম্পাদনা–সুবল সামন্ত ও ইলা ধর ।
• ঘাটালের কথা # পঞ্চানন রায় কাব্যতীর্থ ও প্রণব রায়
• স্বাধীনতা আন্দোলনে চেঁচুয়া হাট # শ্রী দিবাকর ঘোষ
• কৃষ্ণকিশোর আত্মজীবনী # কৃষ্ণকিশোর চক্রবর্তী
• ভগ্ন দেউলের ইতিবৃত্ত # কানাইলাল দীর্ঘাঙ্গী
• স্বাধীনতা আন্দলনে দাসপুর ও পলাশপাই খাল প্রচারের অন্তরালে সহিংস আন্দোলন # দুর্গাপদ ঘাঁটি
• ঘাটাল বর্ষপঞ্জী ২০০২ ,
• ইতিহাস ব্রিটিশ যুগ ( ১৭৫৭ – ১৯৪৭ ) # রোহিনীনাথ মঙ্গল।
• ব্যক্তিগত ঋণ –গোপালচন্দ্র নন্দী, রেবতীমোহন পাত্র, দেবাশিস কুইল্যা প্রমুখ।