দাসপুর থানার স্বাধীনতা আন্দোলন ও মৃগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য যেন অবিচ্ছেদ্য নাম ও সম্পর্ক। এমনই কিংবদন্তি যুগপুরুষের নাম দাসপুর তথা মেদিনীপুর জেলার স্বাধীনতা আন্দোলনেের ইতিহাসে ও আপামর মানুষের হৃদয় ফলকে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে।
এমন বিপ্লবী বীরের কথা আলোচনায় আনতে গেলে দাসপুরের সুপ্রাচীন ইতিহাসে খানিক উঁকি দেওয়া দরকার।
মেদিনীপুর জেলার প্রাচীন চেঁচুয়ার হাট বাংলার শিল্প, সাহিত্য, কৃষি, শিক্ষা ও বানিজ্যে প্রাচীন সভ্যতার সাক্ষ্য বহন করে। বর্তমানে বেশির ভাগ শহর বানিজ্য, শিক্ষায় ও সভ্যতার অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। পূর্বে কিন্তু অনেক অনেক হাট-বাজার সেই ভূমিকা পালন করত। চেঁচুয়ার হাট তারমধ্যে অন্যতম।
প্রায় তিন'শ বছরের লিখিত তথ্য মিললেও প্রকৃতপক্ষে এই হাট আরও প্রাচীন তার অনেক অলিখিত প্রমাণ মেলে। বর্তমানে হাটটি যে স্থানে বসে তা কিন্তু আনুমানিক বারোশ বছর পূর্বে যখন বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারের ঢেউ বাংলায় আছড়ে পড়েছিল তখন হাটটি বসতো বর্তমান অবস্থান থেকে কিছুটা উত্তর পশ্চিমে কাঁসাই নদীর তীরে। এই হাট সংলগ্ন নদী ঘাটটির সঙ্গে তৎকালীন তাম্রলিপ্ত বন্দরের সঙ্গে নদী পথে পরিবহন, ধর্ম প্রচার ও বানিজ্যিক সম্পর্ক চলত। পার্শবর্তী এলাকার ব্যাপক আঁখ চাষ হওয়ার কারণে দাসপুর থানা ব্যাপী কয়েক'শ আঁখমাড়াই কল গড়ে উঠেছিল।আর এখান থেকে উৎপাদিত গুড় সঙ্গে এলাকায় ব্যাপকভাবে উৎপাদিত কুমড়ো, ডাল এবং কুটিরশিল্প জাত কাঁসা পিতলের বাসনপত্র বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে রপ্তানি হত সঙ্গে বাণিজ্যিকভাবে বিড়ি ও সব্জী এবং অন্যান্য খাদ্য দ্রব্যও।
মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল মহকুমার দাসপুর থানা নদীমাতৃক সভ্যতা বহন করে। উত্তর বরাবর শিলাই নদী, পূর্বে রূপনারায়ণ নদ এবং দাসপুর থানার বুক চিরে বয়ে যাওয়া কংসাবতী ও তার শাখা পলাশপাই খাল এ মাটিকে সুজলা-সুফলা-শস্য শ্যামলা করে তুলেছিল প্রাচীনকাল থেকেই।
এখানকার মাটিতে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে ইতিমধ্যে। দাসপুর থানার পার্শ্ববর্তী স্থানে ঘটে যাওয়া সন্যাসী বিদ্রোহ, দাসপুরের বড় শিমুলিয়া গ্রামে ক্ষুদিরাম বসুর নেতৃত্বে বৃটিশ সরকারের ডাক বাক্স ছিনতাই, মাস্টারদা সূর্য সেনের নির্দেশে প্রচারপত্র বিলি ও সর্বশেষ ক্ষুদিরামের ফাঁসির মঞ্চে আত্মবলিদান এই দাসপুরে উর্বর ভূমির স্বাধীন চেতা ভূমি-পুত্রদের স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল ভীষণভাবেই। তারপর ঘাটালে চারণ কবি মুকুন্দ দাসের ১৯২৭ সালে স্বদেশী যাত্রাপালা, আরও এক বীর বিপ্লবী প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্যের স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষা ও কার্যক্রম এখানকার স্বাধীনচেতা মানুষদের আরও দ্বিগুণ উৎসাহে উৎসাহিত করে তোলে।
এই সুবর্ণভূমিতে আর এক দামাল সন্তান যার নাম না করলে চেঁচুয়া ও দাসপুরের ইতিহাস অসমাপ্ত থেকে যাবে তিনি হলেন বাড়জালালপুর গ্রামের মৃগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য।তাঁরই দুর্বার সাহসিকতা ও বুদ্ধিদীপ্ত কয়েকটি কাজ দাসপুর তথা মেদিনীপুরের স্বাধীনতা আন্দোলনকে দ্বিগুণ শক্তিতে ত্বরান্বিত করেছিল। ১৯১০ সালে জন্মলাভ করেই কয়েক মাসের মধ্যেই মাতৃহারা হন তিনি। জ্যাঠাইমার কোলে শুয়ে আদর খেতে খেতে ছোটবেলা থেকেই তিনি জেদি, একগুঁয়ে ও দুঃসাহসী হয়ে ওঠেন। অষ্টম শ্রেণিতে পড়াশুনা চলাকালীন তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় গড়ে ওঠা 'স্পৃশ্য' 'অস্পৃশ্যতা' বিরোধী কাজ করে তৎকালীন সমাজ প্রভুদের কোপে পড়েছিলেন। ছোটবেলাতেই তাঁকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নাড়া দিয়েছিল।বিদ্যালয়ে কৃতি ছাত্র মৃগেন্দ্র নাথ লাঠি খেলা, ছোরা চলানো ইত্যাদি কাজে দক্ষ হয়ে ওঠেন। দশম শ্রেণিতে পড়তে পড়তেই তিনি দাসপুর থানার কংগ্রেস কমিটির সদস্যপদ লাভ করেন এবং মহাত্মা গান্ধীর লবণ আইন আন্দোলনে যোগ দেন।
ইতিমধ্যে বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, যুগান্তর দল, হিন্দুস্থান লিবারেশন আর্মি ও অন্যান্য গুপ্ত সমিতির কার্যক্রম এই দাসপুরের মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছিল। মাদারীপুর গ্রুপ, ময়মনসিংহ গ্রুপ, টিটা-গ্যাঙ গ্রুপ, অনুশীলন সমিতির সদস্য ও বরিশাল, যশোর ও ঢাকার চরমপন্থীরা এই দাসপুরের সংগ্রামীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। এঁদের কার্যক্রমের সঙ্গে মৃগেন্দ্রনাথ ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন।
এরই মধ্যে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ১৯৩০ সালে লবণ আইন অমান্য আন্দোলনের ঢেউ ভারতের অন্যান্য অংশের মতো এই দাসপুর থানায় ছড়িয়ে পড়েছিল তীব্রভাবে। শ্যামগঞ্জ, সোনাখালি, নন্দনপুর, তেমোহানী ঘাট, চক্ কিশোর, চেঁচুয়ার হাট জায়গাগুলি স্বাধীনতা আন্দোলনের উর্বর ক্ষেত্রভূমি হিসেবে চিহ্নিত। মৃগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য, কানন গোস্বামী, বিনোদ বেরা, জীবনকৃষ্ণ মাইতি, মন্মথ মুখার্জি, অরবিন্দ মাইতি, রেবতীরাজ পণ্ডিত, জানকী পণ্ডিত, পুষ্প চ্যাটার্জী, বিনোদ সামন্ত, কিশোরী মাল, রাই মাল সহ আরও আরও শত শত স্বদেশপ্রেমী মানুষ কাঁসাইয়ের প্রধান শাখা পলাশপাইয়ের খালের তীরে চেঁচুয়ার হাটের মাটিকে গর্বিত করেছিল। শ্যামগঞ্জ লবণ আইন আন্দোলনের উৎসমুখ হয়েছিল কারণ বঙ্গোপসাগরের লোনাজল রূপনারায়ণ নদের মাধ্যমে জোয়ারে এসে পৌঁছাত এই স্থানে। সেই লবণাক্ত জল তুলে লবণ তৈরি করতেন ওখানকার কিছু বাসিন্দা। সেই দেশীয় লবণ গ্রামে গঞ্জে বিক্রি করে জীবিকা অর্জনও করতেন তাঁরা।ব্রিটিশ শাসকদের লবণ আইন এঁদেরকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। ইতিমধ্যে এখানকার জাতীয় নেতৃত্বের তত্বাবধানে গঠিত বি.বি.সি.সি-র স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী এই আইনের বিরুদ্ধে লবণ প্রস্তুত কারকদের সঙ্গে নিয়ে জাতীয় নেতৃত্বের নির্দেশ মতো শুরু করেন সভা-পিকেটিং, অবস্থান। উল্লেখ্য স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যরাও লবণ তৈরি ও বাজারে বিক্রির ব্যাপারে ওতপ্রোতভাবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। বয়সে তরুণ হলেও দেশমাতৃকার প্রতি অসীম ভালোবাসা ও কর্মতৎপরতায় মৃগেন্দ্র ছিলের সবার নজরে।
দাসপুর থানার চেঁচুয়ার হাটই ঘাটাল মহকুমার প্রধান ক্রয় বিক্রয় ও স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল তার প্রধান প্রধান কারণগুলি হল- স্বাধীনতা আন্দোলনের থানার মুখ্য নেতৃত্ব -মৃগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, কানন গোস্বামী, যোগেন হাজরা প্রমুখদের বাড়ি এবং কোলাঘাট থেকে নদী পথে শহর কলকাতার ও দেশের অন্যান্য অংশের সঙ্গে সুযোগ ছিলো মালপত্র আদান-প্রদানে। তা হতো রূপনারায়ণ নদ, কাঁসাই নদী ও পলাশপাই খালের মাধ্যমে নদীপথে।
অহিংস আন্দোলনের সাথে সাথে সহিংস আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেন স্বেচ্ছাসেবীদের একটা অংশ। গোপনে যুগান্তর দলের সঙ্গেও যোগাযোগ ছিলো। তাঁরা অনুভব করেছিলেন যে বিনা রক্তপাতে যখন পৃথিবীর কোন আন্দোলনে সফলতা আসেনি তখন তাঁদের সেভাবেই প্রস্তুত থাকতে হবে।
এদিকে দাসপুর থানার ও.সি. ভোলানাথ ঘোষের নেতৃত্বে অত্যাচার চরমে ওঠে। তিনি ও তাঁর সাঙ্গ- পাঙ্গ পুলিশের অমানবিক ধরপাকড় ও অত্যাচারে সংগ্রামী স্বেচ্ছাসেবীদের অনেকে অচৈতন্য হয়ে পড়তেন। তার উপর হাটে বিক্রয়রত দেশীয় লবণ ও বস্ত্র নষ্ট করা হত। তার উপর মূত্র-ত্যাগ সহ নানা নেক্কার জনক ঘটনা ঘটাতে থাকেন। স্বদেশীদের এরেস্ট করে নির্মমভাবে অত্যাচার করতেন ও.সি. ভোলানাথ ঘোষ ওরফে ভোলা দারোগা।
এমন অত্যাচারেও স্বেচ্ছাসেবকদের মনবল দমন করতে পারেননি বরং তাঁদের আন্দোলনের ধার হাজার গুন বেড়ে যায়। উল্লেখ্য এখানকার যাবতীয় আন্দোলনের রূপ-রেখা ও পরিকল্পনা জাতীয় নেতৃত্ব চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস ও ঢাকার সহিংস আন্দোলনের নেতৃত্বদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেই হত।
দাসপুরের ভূমিপুত্র মৃগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য চেঁচুয়া হাট সংলগ্ন বাসিন্দা হওয়ার চেঁচুয়া হাট ও তার সংলগ্ন এলাকা ছিল তাঁর নখদর্পনে। তাই তাঁর উপর দায়িত্ব ছিল এই এলাকায় ব্রিটিশ পুলিশের গতিবিধি ও স্বেচ্ছাসেবীদের মধ্যে খবর আদান প্রদানের কাজ।যেহেতু প্রাচীন চেঁচুয়া হাট ছিল দাসপুর থানার সংস্কৃতি ও অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের প্রাণকেন্দ্র সেইহেতু দাসপুর থানার অন্যান্য অঞ্চলের থেকে এই চেঁচুয়া হাটের উপর নজরদারী ছিল বেশি বেশি। এলাকায় কয়েকজন বিত্তশালী ব্যক্তি অধিক মুনাফা লাভের জন্য দেশের স্বার্থ না ভেবে ইংরেজদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চেঁচুয়ার হাটকে বিদেশি দ্রব্য বিক্রয়ের উন্মুক্ত প্রান্তর করেছিলেন। তাই এই চেঁচুয়া হাটই স্বদেশীদের আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল।আর অন্যান্য স্বদেশীদের মতই মৃগেন্দ্রনাথ ছিলেন চেঁচুয়া হাটের বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্রণী মুখ। তাই তিনি চেঁচুয়া হাটকে পাখির চোখ করে ২৪ ঘন্টা নজর রাখতেন। তিনি এখানকার সকল খবরাখবর স্বদেশীদের গোপনে প্রদান করতেন।
এই দাসপুরের ইতিহাসে আন্তর্জাতিক ঘটনাবলী দারুণ ভাবে প্রভাব ফেলেছিল। ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব পালা বদল ঘটে। রাশিয়ার নভেম্বর বিপ্লব সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের উপর দৃপ্তময় সাড়া দিয়ে মেরুদণ্ডকে অনমনীয় করে দিয়েছিল। তার প্রভাব ভারতবর্ষের উপর সর্বাগ্রে পড়েছিল। আদর্শগত বিরোধিতা থাকলেও মহাত্মা গান্ধীকে রাশিয়ার সুশৃঙ্খল জনউত্তালের কাছে শিক্ষা নিয়ে আন্দোলনের রূপরেখার কিছু পরিবর্তন করতে হয়েছিল।
ঢাকা যুগান্তর পার্টি, অনুশীলন সমিতি ও অন্যান্য চরমপন্থীদের সিংহভাগই রাশিয়ার কমিউনিস্ট আন্দোলনকে কুর্নিশ জানিয়েছে পরবর্তী সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ গ্রহন করছিলেন। সেখানে দাসপুরের স্বদেশীেরাও ছিলেন অনেকেই। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন মৃগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য। তাঁরই নেতৃত্বেই পরবর্তী সময়ে দাসপুরে কমিউনিস্ট আন্দোলন ও সংগঠন এক শক্তিশালী রূপ নিয়েছিল। এই কারণেই স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে এই দাসপুর থানায় কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রভাব বেশি বেশি পড়েছিল। তার প্রমাণ পাওয়া যায় যখন ১৯৪৭ সালের পর সংবিধান অনুসারে ১৯৫২ প্রথম নির্বাচন হয় সেই নির্বাচনে মৃগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে দাসপুর কেন্দ্র থেকে বিপুলভাবে জয়ী হয়ে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভায় সদস্য হন। আবার১৯৬২ সালেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটে।
যাই হোক আন্তর্জাতিক রাজনীতির কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে মহাত্মা গান্ধী যখন আন্দোলনের ধার তীব্র করেন তার প্রভাব এই দাসপুরে দারুণ ভাবে পড়েছিল। বাম ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দাসপুরের স্বদেশীরা প্রথমে এই আন্দোলনে কৃষক শ্রেণীকে বেশি বেশি উদ্বুদ্ধ করে আন্দোলনের ধারকে আরও বাড়িয়েছিলেন। তখন বয়সে তরুণ হলেও মৃগেন্দ্রনাথ তার অগ্রণী সহযোদ্ধার ভূমিকা পালন করেছিলেন।
যে দিনটির জন্য বীর বিপ্লবী মৃগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য দাসপুরের ইতিহাসে কিংবদন্তি সেই ঘটনার চরম আকার নেয় বাংলার ১৩৩৬ সালের ২০শে জ্যৈষ্ঠ মঙ্গলবার, ইংরেজি- ১৯৩০এর ৩রা জুন। সেদিনটা ছিল মঙ্গলবারের ভরা হাট। পোড়ানো হল বিলেতি কাপড়।খবর পৌঁছে যায় দাসপুর থানায়। ওসি মি.ভোলানাথ ঘোষ সঙ্গে সাব-ইন্সপেক্টর অনিরুদ্ধ সামন্ত কিছু কনস্টেবল নিয়ে হাটে পৌঁছান। ইতিমধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়ে পার্শ্ববর্তী এলাকায় ও বিশেষ করে স্বেচ্ছাসেবকদের আর এক আস্তানা চক্ কিশোর গ্রামে, যে স্বেচ্ছাসেবী -কালিপদ সামন্ত, হরিপদ মাজী, প্রবোধ সামন্ত ও তারাপদ চক্রবর্তীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
সেদিন হাটে সবার আগে উপস্থিত হন বয়সে তরুণ সংগ্রামী মৃগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য, মাথায় গান্ধী টুপি। দারোগা ভোলানাথ মাটিতে বসতে বলেন মৃগেন্দ্রকে। অকুতোভয় মৃগেন্দ্র পুলিশের বেঞ্চ দখল করে বসেন। তা দেখে ভোলানাথ দারোগা ক্রুদ্ধ হয়ে লাঠি চালাতে থাকেন সাহসী তরুণ মৃগেন্দ্র ভট্টাচার্য্যের উপর। তারপর মৃগেন্দ্র চকিতের মধ্যে সেই লাঠি কেড়ে নিয়ে ভোলা দারোগার উপর উপর্যুপরি প্রহার করতে থাকেন। উৎসাহিত স্বেচ্ছাসেবী ও হাটের সমবেত মানুষ সহ অসংখ্য মেয়েরাও ঝাঁটা কুড়ুল, কাঠারি নিয়ে পুলিশের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। ভোলানাথ প্রাণ ভয়ে দৌড়ে স্থানীয় এক বিত্তশালী ব্যবসায়ীর খামার বাড়িতে আশ্রয় নেন। উক্ত ব্যবসায়ী ভোলানাথকে আড়াল করার চেষ্টা করেলেও উত্তেজিত জনতা সেখান থেকে বের করে আনেন। তারপর ঘটনাস্থলে ও.সি.ভোলানাথ ঘোষের মৃত্যু হয়।রাতের অন্ধকারে তাঁর দেহ গোবিন্দনগর গ্রামের 'ডোমনার' মাঠে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আর সাব ইন্সপেক্টর অনিরুদ্ধ সামন্তের দেহ বোওয়ালিয়ার মাঠে চিৎমল্লিকা পুকুরের জলে টুকরো টুকরো করে ভাসিয়ে দেন বিক্ষুদ্ধ মানুষ। আর বাকী পুলিশের কয়েকজন আত্মসমর্পণ করেন এবং উর্দি খুলে বন্ধুক ত্যাগ করে পলাশপাই খালের খাসি কাটার ঘাট টপকে কোন রকমে প্রাণে বাঁচেন।
এমন আক্রমণ ও ব্রিটিশ পুলিশের প্রাণহানির খবর চলে যায় ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট প্যাডী সাহেবের দপ্তরে! দাসপুর থানা জুড়ে অহিংস ও সহিংস আন্দোলনের এমন ব্যাপকতার বিষয়ে পূর্বে জানা ছিল না। পরের দিনই বিশাল গোরা সেনা ও পুলিশ বাহিনী পৌঁছায় গোবিন্দনগর গ্রামের চেঁচুয়া হাটে। চলে ধরপাকড় এ গ্রাম ছাড়াও পাশাপাশি গ্রামে। নেমে আসে পুলিশের নির্মম অত্যাচার। পুরুষেরা সবাই গৃহছাড়া। পুলিশ পিকেটিং এর নামে মেয়েদের উপরেও চলে অত্যাচার, সঙ্গে লুটপাট। এরেস্ট হয় শয়ে শয়ে।
এদিকে এই চেঁচুয়া হাট কাণ্ডের মূল হোতা মৃগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যকে না পেয়ে তাঁর বাড়ির উপর নেমে আসে চরম অত্যাচার। বাবার ডাক্তরী সরঞ্জাম, তাঁদের গৃহ দেবতার পূজার উপকরণ লুটপাট ও ভাঙচুর, চাষবাসের উৎপন্ন ফসলে আগুন লাগিয়ে দেওয়া এমন নানান নির্মম অত্যাচার চলতে থাকে। শেষে তিনি আত্মগোপন অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে ঘাটাল এস. ডি. ও শঙ্কর সেনের নিকট আত্মসমর্পণ করেন। প্রায় ছ'মাস ধরে তাঁর বিচার প্রক্রিয়া চলতে থাকে। ব্যারিষ্টার বীরেন্দ্র নাথ শাসমল ও ব্রিটিশ আইনজীবীর মধ্যে মৃগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের শাস্তি নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলে। সরকার পক্ষের আইনজীবী এত বড় হত্যাকাণ্ডের জন্য মৃগেন্দ্রের ফাঁসির জন্য দাবী করেন। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষ কোন প্রমাণের তথ্য জমা না দিতে পারায় ও বয়সের কথা চিন্তা করে মৃগেন্দ্রনাথের দ্বীপান্তর বা ফাঁসির পরিবর্তে ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
গ্রেফতার হওয়া অন্যান্য সংগ্রামীদের জন্য সুভাষ চন্দ্র বসুর অনুরোধে কলকাতা হাইকোর্টে সওয়াল করলেন প্রখ্যাত আইনজীবী এস.সেন। সঙ্গে ছিলেন তৎকালীন মেদিনীপুর জেলার কংগ্রেস নেতা ও বিখ্যাত ব্যারিষ্টার বীরেন্দ্রনাথ শাসমলও।
প্রায় ছয় মাস বিচার চলার পর যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয়- কানন গোস্বামী, মৃগেন্দ্র নাথ বাগ, যোগেন্দ্র হাজরা, শীতল ভট্টাচার্য, বিনোদ বেরা এবং ভুতনাথ মান্নার। সাত বছরের জেল হল কালাচাঁদ ঘাঁটি, ব্রজ ভুঁইয়া, কালিপদ সামন্ত, জীবন পতি ও যুগল মালের। ফায়ারিং জেলে ৫০ জনের শাস্তি হল। তাদের মধ্যে রাধানাথ ঘাঁটি (গোবিন্দ নগর),অষ্টম হাজরা, রজনী পাঁজা, প্রাণকৃষ্ণ গুছাইত, ক্ষিতীশ মণ্ডল প্রমুখের। আর পরে বেশ কিছু সংগ্রামীদের শ্বাপদ-সংকুল অরণ্যের হিংস্র পশুদের মাঝে ছেড়ে দেওয়া হল।
এদিকে চেঁচুয়ার হাটে পুলিশের ক্যাম্প থেকে অত্যাচারের মাত্রা ক্রমশ বেড়েই চলে। অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবীরা রাতারাতি চক্ কিশোর গ্রামে
সভা ডাকলেন। সিদ্ধান্ত হয় তীব্র আন্দোলন ও অবরোধে-অবরোধে হাট থেকে ক্যাম্প হটিয়ে দিতে হবে।এ নির্দেশ আসে ঢাকার অনুশীলন সমিতির ও সি.আর.দাশ ও নেতাজী সুভাসচন্দ্র বোসের কাছ থেকেও। ১৯৩০ সালের ৬ই জুন সকাল থেকে দাসপুরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবী ও স্বাধীনতাকামী মানুষ চেঁচুয়ার হাটের পূর্ব দিকে পলাশপাই খাল পাড়বাঁধ বরাবর সমবেত হন। হাজার হাজার কণ্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে 'বন্দেমাতরম' ধ্বনি সঙ্গে -''ইংরেজ দূর হটাও। চেঁচুয়ার হাট থেকে অবিলম্বে ক্যাম্প তুলতে হবে।" উল্লেখযোগ্য বিষয় হল উক্ত তারিখে বৃটিশ জেলাশাসক প্যাডি সাহেব পাঠান পুলিশ নিয়ে উপস্থিত হয়ে হাঁক দিয়ে বলতে থাকেন, "তোমরা জনতা কমাও, গুপ্ত ঘাঁটির সন্ধান দাও, দোষীদের ধরিয়ে দাও তোমাদের কিছুই হবে না। এমন আবেদনে জনতা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে এবং তাঁরা পলাশপাই নদী খাল অতিক্রম করে ইংরেজ সৈন্যদের দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং ব্যারিকেডকে আরও মজবুত করতে থাকেন। এসব দেখে ভীত প্যাডী ও ফিড সাহেব গুলি চালানোর নির্দেশ দেন এবং ইংরেজ গোরা সেনা ও সিপাহীরা প্রাণ ভয়ে ঐ হাজার হাজার জনতার দিকে গুলি চালাতে চালাতে কাঁসাইয়ের শাখা পলাশপাই খালের খাসি কাটা ঘাট পেরিয়ে পালিয়ে যান।
কিন্তু হায়! ঐ বর্বর জাতির সিপাহীদের গুলিতে শত শত মানুষ আহত ও ১৪ জন বীর বিদ্রোহী শহীদ হলেন। শহীদরা হলেন-১।চন্দ্র কান্ত মান্না(তেমোহানী) ২।শশিভূষণ মাইতি(সয়লা) ৩।কালিপদ শাসমল(জালালপুর) ৪। ভৃগুরাম পাল(মোহনমাইতিচক) ৫।দেবেন্দ্রনাথ ধাড়া(জ্যোৎভগবান) ৬।সতীশচন্দ্র মিদ্যা(বাড় রাধাকৃষ্ণপুর) ৭।রামচন্দ্র পাড়ুই(জ্যোৎশ্যাম) ৮।নিতাই পড়্যা(পাঁচবেড়িয়া) ৯।অবিনাশ দিন্ডা(বাঁশখাল) ১০।অশ্বিনী দোলই(চক্ বোয়ালিয়া) ১১।সত্য বেরা(বাঁশখাল) ১২। শশী দিন্ডা(গোবিন্দনগর)১৩।পূর্ণ চন্দ্র সিংহ(খাড়) ১৪। মোহন মাইতি। এই শহীদদের মৃত্যুর খবর শুনে মহাত্মা গান্ধী বড্ড শোকাহত হয়েছিলেন। এইভাবে চেঁচুয়ার হাটে শহীদদের রক্ত, শোকার্ত মায়েদের গগনভেদী চিৎকার মেদিনীপুর জেলার স্বাধীনতা আন্দোলনে শত শক্তি সঞ্চারিত করল।
যে ভূমিপুত্রের একটি দুঃসাহসিক কাজের জন্য এত বড়ো ঘটনাটি ঘটে এবং এমন ভারতবর্ষের দুঃসাহসিক আন্দোলন ইতিহাসের পাতায় খোদিত হয়েছে সেই মৃগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের জেল মুক্তি হওয়ার পর তাঁর আন্দোলনের ধার আদৌ কমেনি বরং পরাধীন ভারতে তেভাগা কৃষক আন্দোলন ও স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ পাওয়া ও শোষণ মুক্তির জন্য আজীবন সংগ্রাম করতে করতে ১৯৭২ খ্রীস্টাব্দে ১৪ জুলাই তাঁর মেয়ের বাড়ি অমরপুরে হৃদরোগে আক্রান্ত হন। পরে এই অমর দেশপ্রেমিক, দাসপুরের আবালবৃদ্ধবনিতার প্রিয় নেতা মৃগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ঘাটাল মহকুমা হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আজ দাসপুর থানা ও মেদিনীপুর জেলার অনেক সরকারি ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
কিন্তু এত বড়ো দুর্বার আন্দোলন যা ভারতের জাতীয় আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করেছিল এবং ইংরেজদের শাসনের ভীতকে নাড়িয়ে দিয়েছিল সেই আন্দোলনের ইতিহাস ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও জাতীয় ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পায়নি।