অরবিন্দ মাইতি
স্বাধীনতা সংগ্রামী অরবিন্দ মাইতির জন্ম দাসপুরের গোছাতি গ্রামে। তিনি ১৯২০ খ্রি. দাসপুর থানা কংগ্রেস কমিটির সম্পাদক হন। ১৯৩০ খ্রি. গান্ধীজীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে লবণ সত্যাগ্রহ ও মাদক দ্রব্য বয়কট আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মে মাসে লবণ তৈরী কেন্দ্র থেকে অরবিন্দ ও তাঁর দাদা জীবনকৃষ্ণকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। বিচারে দু'জনের ৬ মাস করে ১ বছর জেল হয়। এই সময় তাঁকে ঘাটাল-মেদিনীপুর-বহরমপুর প্রেসিডেন্সী জেলে আটক থাকতে হয়। ১৯৩৪ খ্রি. কংগ্রেস বেআইনী ঘোষিত হলে তাঁকে গ্রেপ্তার করে ১ বছর ডেটিনিউ করে রাখা হয়। ১৯৪২ খ্রি. নভেম্বর মাসে ঘাটাল ট্রেজারি লুঠ ও ডাক বাংলো পোড়ানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এই মিথ্যা অভিযোগে অরবিন্দসহ ঘাটালের ১৭ জন কংগ্রেস কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১ বছর পরে তাঁকে ১০ হাজার টাকা জামিনে মুক্তি দিলেও মহকুমা শাসক মেদিনীপুর জেলা থেকে বহিষ্কারের নির্দেশ দেয়। ১১ ই ডিসেম্বর ২০০১ খ্রীস্টাব্দে নিজ বাস ভবনে অরবিন্দের মৃত্যু হয়।
অন্নদাপ্রসাদ চৌধুরী
অন্নদাপ্রসাদ চৌধুরীর পৈতৃক বাসস্থান ক্ষীরপাই। ১৩০২ বঙ্গাব্দে কটকে জন্ম। কংগ্রেস করার অপরাধে বহুবার কারারুদ্ধ হন। ১৯৪৬ খ্রি. তিনি বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হন ও ডঃ প্রফুল্ল ঘোষের প্রথম মন্ত্রীসভায় পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রী হন। রাজনৈতিক কারণে তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করে সোশালিষ্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। অন্নদাপ্রসাদ পশ্চিমবঙ্গ বিধান পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি সর্বভারতীয় খাদি বোর্ড ও রাজ্য খাদি বোর্ডের সদস্য ছিলেন। ক্ষীরপাই শহরে ‘লোকসেবা সমিতি’ গঠন করে চরকা, তাঁত প্রভৃতি গ্রামোদ্যোগ প্রকল্পের ব্যবস্থা করেন। মৃত্যু হয় ১৩৭১ বঙ্গাব্দের ৩০ ভাদ্র।
অমূল্যচরণ ডাল
চন্দ্রকোণা থানার দামোদরপুর গ্রামে জন্ম। অমূল্যচরণ সুকুমার সেনগুপ্ত ও ডাঃ যতীশচন্দ্র ঘোষের রাজনৈতিক সহায়ক হিসেবে কাজ করতেন। ১৯৫২ খ্রি. তিনি কমিউনিস্ট পার্টির মনোনীত প্রার্থী রূপে ঘাটাল কেন্দ্র থেকে বিধানসভায় নির্বাচিত হন।
অমলেশ্বর সিংহ
চন্দ্রকোনার কেঁচকাপুরে জন্ম। ১৯২১ এ অসহযোগ আন্দোলনের অন্যতম সক্রিয় কর্মী। ১৯৩২ এ পুলিশী নির্যাতনে মৃত্যু।
অষ্টম হাজরা
জন্ম দাসপুরের তাতার খাঁ গ্রামে। ১৯৩০ এ চেঁচুয়া হাটে উত্তেজিত জনতার হাতে ভোলা দারোগা ও এস আই অনিরুদ্ধ সামন্তের মৃত্যুর জন্য ব্রিটিশ সরকার যে ৩৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে, ইনি তাদের অন্যতম। স্পেশাল ট্রাইবুনালের বিচারে অন্যদের সঙ্গে তারও যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয়।
অলৌকিক চন্দ্র মাইতি
জন্ম বৈশাখ ১৩০১, দাসপুরের গোছাতি গ্রামে। পিতা ঈশ্বরচন্দ্র। ১৯২১ এর অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের কারণে কারাবরণ করেন। ১৯২৩-২৪ পর্যন্ত রবিদাসপুর কংগ্রেস কমিটির উপদেষ্টা ও সক্রিয় কর্মী। মৃত্যু ভাদ্র, ১৩২৯ সালে।
আশুতোষ দিণ্ডা
স্বাধীনতা সংগ্রামী। রবিদাসপুর। ১৯২২-২৩ রবিদাসপুর কংগ্রেস কমিটির সক্রিয় সদস্য। ৪ নং অঞ্চলের প্রথম ব্যক্তি যিনি গান্ধিজিকে দর্শন করেন।
আশুতোষ সিংহ
কেঁচকাপুর, চন্দ্রকোনা। জমিদার পরিবারের সন্তান। স্বদেশী আন্দোলনে তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। কলকাতার নেতৃত্ববৃন্দের সঙ্গে প্রধান যোগাযোগকারী ছিলেন তিনি।
কাননবিহারী গোস্বামী
কাননবিহারীর জন্ম তিলন্দা (দাসপুর) গ্রামে। পিতা অম্বিকা। চেঁচুয়ায় ভোলা দারোগা হত্যা মামলায় (১৯৩০) তিনি অভিযুক্ত হন। বিচারে তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। আন্দামান, রাজশাহী প্রভৃতি জেলে তাঁকে বন্দী রাখা হয়। ১৯৪৭ খ্রি. তিনি আন্দামান থেকে মুক্তি পান।
কালীপদ মণ্ডল
কালীপদ মণ্ডলের জন্ম ঘাটালের নিশ্চিন্দীপুরে। পিতা লক্ষ্মণচন্দ্র মণ্ডল। তিনি ঘাটাল কংগ্রেস কমিটির সম্পাদক ছিলেন এবং ১৯৩০ খ্রি. মাদকদ্রব্য বর্জন ও লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সময় পিকেটিং-এ অংশ নেন। কালীপদ ঘাটাল সাবজেলে ৬ মাসের জন্য জন্য কারারুদ্ধ ছিলেন। সেই সময় দৈহিকভাবে নির্যাতীত হন। ১৯৩০ খ্রি. মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে ৬ মাসের জন্য বন্দী থাকেন। ১৯৩২ খ্রি. পর কয়েকবার ঘাটাল সাবজেলে কারারুদ্ধ থাকেন। ১৯৩৮ খ্রি. কালীপদ জাতীয় কংগ্রেসের কাজকর্মে অংশ নেওয়ার জন্য মেদিনীপুর চলে যান। তারপর থেকে তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায় না।
কিশোরীপতি রায়
চন্দ্রকোণা থানার জাড়া গ্রামের জমিদার যোগেন্দ্রচন্দ্র রায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র কিশোরীপতি (১৮৭৩–১৯৪৩) মেদিনীপুর কোর্টের ব্যবহারজীবী ছিলেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় কংগ্রেসে যোগ দেন। মেদিনীপুর জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক নির্বাচিত হন। অসহযোগ আন্দোলনে কিশোরীপতি ৩৭ হাজার স্বেচ্ছাসেবকের অধিনায়ক ছিলেন। ১৯২২ খ্রি. দিল্লীতে সারা ভারত কংগ্রেস সম্মেলনে যোগদানের পথে তাঁকে গ্রেপ্তার করে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে রাখা হয়। সেই সময় বিভিন্ন কারণে বন্দী হয়ে আসা দেশবন্ধু, দেশপ্রাণ, নেতাজী, আবুল কালাম আজাদ প্রভৃতি কংগ্রেস নেতৃবর্গের সঙ্গে একই জেলে কারারুদ্ধ কিশোরীপতির আলাপ হয়। তাঁর মেদিনীপুরের বাড়ীতেই কংগ্রেস কার্যালয়, জাতীয় বিদ্যাপীঠ, তাঁতশালা ও মহিলা কংগ্রেস বৈঠকের কেন্দ্র ছিল। বার্জ হত্যা (১৯৩৩) সূত্রে ১৯৩৪ খ্রি. কিশোরীপতি সরকারী আদেশে মেদিনীপুর থেকে বিতাড়িত হন। ১৯৩৭ খ্রি. ঘাটালঝাড়গ্রাম যুগ্ম কেন্দ্র থেকে এ্যাসেম্বলী নির্বাচনে সরকারী প্রার্থী ঝাড়গ্রামের রাজাকে পরাজিত করে নির্বাচিত হন।
কিশোরী মাল
গোছাতি, দাসপুর। ১৯২৮-২৯ সোনাখালী কংগ্রেস দলের অন্যতম সক্রিয় কর্মী। ভোলা দারোগা হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত। মেদিনীপুর থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। নন্দনপুর-তেমোহানি অঞ্চল কংগ্রেস কমিটির সম্পাদক হিসেবেও কাজ করেছেন।
ক্ষুদিরাম বসু
ক্ষুদিরামের জন্ম ১৮৮৯ খ্রি. ৩রা ডিসেম্বর। মেদিনীপুর শহর সংলগ্ন হবিবপুরে। পিতা ত্রৈলোক্যনাথ মাতা লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী। হবিবপুরে জন্ম হলেও জীবনের সূচনাপর্বের বেশ কিছুটা সময় কেটেছে দাসপুরের হাটগেছিয়া গ্রামে। ৬ বৎসর বয়সে ক্ষুদিরাম পিতা মাতাকে হারান। বড়দি অপরূপা দেবীর স্বামী অমৃতলাল রায় ঘাটাল দেওয়ানী আদালতে কাজ করতেন। ক্ষুদিরাম ও তাঁর ছোটদি ননীবালাকে অমৃতলাল হাটগেছিয়া গ্রামে নিজ বাড়ীতে আনেন। এই গ্রামের শিক্ষক গিরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় পাঠশালায় ক্ষুদিরামের শিক্ষাজীবন শুরু। ইতিমধ্যে অমৃতলাল তমলুকে বদলি হলে ক্ষুদিরাম তমলুক হ্যামিলটন স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯০৪ খ্রি. অমৃতলাল মেদিনীপুরে বদলি হয়ে এলেও ক্ষুদিরাম মেদিনীপুর কলিজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। স্বদেশপ্রেমের বীজ পূর্বেই উপ্ত হয়েছিল। দীক্ষা নিয়েছেন অগ্নিমন্ত্রে। ঝাঁপিয়ে পড়েছেন স্বাধীনতা আন্দোলনে। ১৯০৮ খ্রি. ৩০ এপ্রিল ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী মজঃফরপুরে কুখ্যাত কিংসফোর্ডের গাড়ী ভেবে ভুলক্রমে অন্য গাড়ীতে বোমা নিক্ষেপ করেন। মারা যান মিস ও মিসেস কেনেডি। ক্ষুদিরাম ধরা পড়েন। সত্য, ন্যায় ও আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয় ১৯০৮ খ্রি.।
গয়ারাম সিংহ রায়
১৯০৮ সালে ঘাটালে জন্ম। পুলিশের অত্যাচার উপেক্ষা করে জাতীয়তাবাদী প্রচারপত্র ঘাটালে এনে গোপনে বিলি করতেন। বার্জ হত্যা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে কারাবরণ করেন। দীর্ঘদিন অন্তরীণ থাকতে হয় বিভিন্ন জায়গায়। ঘাটাল-কোলাঘাট নদীপথে ব্রিটিশ মালিকানাধীন ‘হরমিলার’ কোম্পানির সঙ্গে স্বদেশী ‘ঘাটাল স্টীম নেভিগেশন কৌম্পানি লিঃ’ এর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।
জীবনকৃষ্ণ মাইতি
জন্ম ১৯০৫ সালের ২১ নভেম্বর গোছাতি গ্রামে (দাসপুর)। পিতা পরমেশ্বর। দাসপুর থানাতে স্বদেশী আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করার পিছনে জীবনকৃষ্ণেরও বিশেষ অবদান ছিল। দাসপুরের শ্যামগঞ্জে লবণ তৈরী ও বিক্রীর অপরাধে জীবনকৃষ্ণকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। ১৯৩০ খ্রি. লবণ আইন ও দণ্ডবিধির ১২৪ ধারা মতে, জীবনকৃষ্ণকে ১ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। ১৯৩৪ খ্রি. কংগ্রেস দলকে বেআইনী ঘোষণা করলে জীবনকৃষ্ণকে আটক রাখা হয়।
জানকীনাথ রাজপন্ডিত
জন্ম ১৬ ই ভাদ্র ১৩১৭, বরুণা উদয়চক দাসপুর। পিতা যোগেন্দ্রনাথ। স্বাধীনতা সংগ্রামী পিতার প্রভাবে সোনাখালি হাই স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেন। ১৯৩০ সালে শ্যামগঞ্জ লবণ সত্যাগ্রহে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় তিনি দশম শ্রেণীর ছাত্র। ২৬ শে জানুয়ারী ১৯৩১ সোনাখালি হাটে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের অপরাধে গ্রেপ্তার হন। ছয় মাসের সশ্রম কারাদণ্ড হলেও গান্ধী আরউইন চুক্তির কারণে ৩১ শে আগস্ট ১৯৩১ মুক্তি পান। কয়েক বছর পড়াশোনা বন্ধ। স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপিনবিহারী গাঙ্গুলীর সংস্পর্শে এসেছেন। পরে পড়াশোনা করতে চাইলেও পুলিশি বাধায় সম্ভব হয়নি। পরে শিবপুর দীনবন্ধু থেকে ম্যাট্রিকুলেশন ও তারপরে প্রাইভেটে এমএ পাশ করেন। পেশা হিসেবে বেছে নেন শিক্ষকতাকে। মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সংস্পর্শেও আসেন। বহু সাংস্কৃতিক ও জনহিতকর কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। কোলাঘাটে বসবাস করেছেন। মৃত্যু ১২ ই অগ্রহায়ণ ১৩৮৬ ।
জওহরলাল বক্সী
সুলতানপুর ঘাটাল। বিশিষ্ট কংগ্রেস কর্মী ও স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মী। নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের বিশেষ পরিচিত। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘাটালে নেতাজির শুভাগমন ১৮ই মে ১৯৩৮। নেতাজির এই সফর সূচি নির্দিষ্ট করেন তিনিই। নেতাজিকে এলগিন রোডের বাড়ি থেকে ঘাটাল পর্যন্ত আনার জন্য তিনি অন্যতম সক্রিয় কর্মী অরবিন্দ মাইতিকে নেতাজীর কাছে পাঠিয়েছিলেন। ১৯৩৮ এর ডিসেম্বরে মেদিনীপুরের বিদ্যাসাগর স্মৃতি মন্দিরে দ্বারোদঘাটনের পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যাতে স্হানীয় নির্যাতীত কর্মীদের সাথে সাক্ষাৎ করেন সে বিষয়ে কথা বলার জন্য মেদিনীপুর থেকে শান্তিনিকেতনে জেলা কংগ্রেসের পক্ষে তিনি গিয়েছিলেন।
দেবেন্দ্রলাল খান
নরেন্দ্র পুত্র দেবেন্দ্রলাল জেলার বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা।১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি মেদিনীপুর জেলা বোর্ডের সভাপতি এবং বেঙ্গল কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৩১ খ্রি. ৭ এপ্রিল মেদিনীপুরের জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মিঃ পেডিকে হত্যা করা হয়। হত্যা মামলায় অভিযুক্ত বিমল দাশগুপ্তকে নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে মুক্ত করেন। পরবর্তী ম্যাজিষ্ট্রেট মিঃ ডগলাসেেক হত্যার পর সরকারী নির্দেশে পুলিশের চৌকী বসানোর জন্য দেবেন্দ্রলালকে বসতবাড়ী খালি করে দিতে হয়।
নরেন্দ্রলাল খান
নরেন্দ্রলাল ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে নাড়াজোল তথা মেদিনীপুরের জমিদার হন। মেদিনীপুর বোমা মামলার সূত্রে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ২৮ ও ২৯ আগস্ট তাঁর গোপপ্রাসাদ, কর্ণেলগোলার কাছারিবাড়ী, আবাসগড়ের বাড়ী ও নাড়াজোলের রাজবাড়ীতে তল্লাসী চালানো হয়। সন্দেহজনক কিছু না পাওয়া গেলেও মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে তাঁকে ৭ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আটক রাখা হয়। তারপর পঞ্চাশ হাজার টাকা জামিনে মুক্তি পেয়ে নিজ খরচে পুলিশ প্রহরায় নিজ বাড়ীতে নজরবন্দী থাকেন। প্রমাণাভাবে ৯ই নভেম্বর মামলা খারিজ হয়ে যায়। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারী তাঁর মৃত্যু হয়।
নাগেশ্বরপ্রসাদ সিংহ
চন্দ্রকোণার কেঁচকাপুরে বাড়ি। নাগেশ্বরপ্রসাদ স্বদেশী আন্দোলনের সময় প্রচারকের ভূমিকার উল্লেখযোগ্য কাজ করেন। গড়বেতার রামসুন্দর সিংহ ও নাগেশ্বরপ্রসাদ এর পরিবারের সুসম্পর্ক ছিল। তাঁর প্রেরণায় দুই পরিবারের যুবকগণ কোলকাতার স্বদেশী আন্দোলনের নেতৃত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখতেন। নাগেশ্বরপ্রসাদের নেতৃত্বে ও আন্তরিক চেষ্টায় রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ঘাটালে আসেন।
নন্দলাল মান্না
দাসপুর থানার পার্বতীপুর গ্রামের দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান। জন্ম ১৩ জুলাই ১৯০৭। পিতা চন্দ্রকান্ত। স্বাধীনতা সংগ্রামী ও সমাজপরিবর্তন আন্দোলনের বিশিষ্ট কর্মী। ১৯৩০-এ আইন অমান্য আন্দোলনে অংশ নিয়ে কারাবরণ করেন। মৃত্যু ৯ জুলাই ১৯৮৯।
নিত্যানন্দ রায়
জন্ম ১৯১০ শ্রীমন্তপুর খাসবাড় ঘাটাল। স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত হয়ে কারাবরণ করেছেন ১১ বার। আন্দামান সেলুলার জেলেও বন্দী ছিলেন বেশ কিছুদিন। কলকাতার বিশ্বনাথ আয়ুর্বেদ কলেজ থেকে পাশ করে ১৯৩৭ এ ঘাটালে আসেন। প্রখ্যাত কংগ্রেস কর্মী ও পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র সেনের প্রিয় পাত্র মানুষটি মাত্র ১১ বছর বয়সে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন।
নিত্যানন্দ জীবনের দুটি স্মরণীয় ঘটনা ১)১৯৩৮ এ নেতাজি সুভাষচন্দ্রের যখন ঘাটালে পদার্পণ ঘটে, তখন তিনি বরদার চৌরাস্তা থেকে আড়গোড়া পর্যন্ত এসেছিলেন ঘোড়ায় চেপে জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে অভিবাদন জানাতে জানাতে। সঙ্গে ছিল বিরাট সুসজ্জিত জনতা। ২) ১৯৪২ এ গ্রেপ্তারি এড়াতে যখন প্রফুল্ল সেন তাঁর জ্ঞাতিভাইয়ের বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন তখন তাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসেন। বহু জনকল্যাণমূলক কাজে যুক্ত ছিলেন আজীবন। মৃত্যু ১৫.৯.২০০৪।
প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য
জন্ম ১৯১৩ সালের ৩ নভেম্বর দাসপুরের গোকুলনগর গ্রামে। পিতা ভবতারণ, মাতা পঙ্কজিনী দেবী। প্রদ্যোৎ মেদিনীপুরের হিন্দু স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে মেদিনীপুর কলেজে ইন্টারমিডিয়েট বিজ্ঞান ক্লাসে পড়ার সময় শহরের বিপ্লবী গোষ্ঠী বেঙ্গল ভলাণ্টিয়ার্স এর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসেন। অত্যাচারী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পেডি হত্যার পর কুখ্যাত ডগলাস হত্যার কাজে নিজেই নিজেকে নির্বাচন করেন। এই কাজে তাঁর সতীর্থ বন্ধু দাসপুরের খাঞ্জাপুরের প্রভাংশু পালও নির্বাচিত হন। ১৯৩২ সালে ৩০ এপ্রিল প্রভাংশুর গুলিতে ডগলাস নিহত, তবুও বিচারে ১৯৩৩ সালে ১২ জানুয়ারি মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে প্রদ্যোতের ফাঁসি হয়।
প্রভাংশু পাল
দাসপুরের খাঞ্জাপুর গ্রামে প্রভাংশুর বাড়ি। পিতা ডাঃ আশুতোষ পাল ও মাতা লক্ষীমণি দেবী। পড়াশুনার জন্য মেদিনীপুরে মামাবাড়িতে থাকতেন। হিন্দু স্কুলের ছাত্র থাকাকালীন বি.ভি. দলের নিষ্ঠাবান কর্মী হয়ে ওঠেন। অত্যাচারী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাসকে হত্যা করার জন্য প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য ও প্রভাংশু পালের উপর দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রভাংশুর রিভলবারের নিক্ষিপ্ত পাঁচটি গুলি ডগলাসের বুক ঝাঁঝরা করে দেয়। পরে প্রভাংশু গ্রেপ্তার হলেও তাঁর অপরাধ প্রমাণ করা যায় নি। মুক্তি পেয়ে যান। পরে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বার্জ হত্যায় তাঁকে গ্রেপ্তার করে ১৯৩৩-১৯৩৮ পর্যন্ত ডেটিনিউ করে রাখা হয়েছিল। ২ জুন ২০০৭ কলকাতার আনন্দলোক হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়।
পার্বতীচরণ দিন্ডা
বাড়ি রবিদাসপুর, দাসপুর। অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে কাজ করার জন্য ঘাটাল বিদ্যাসাগর উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন ত্যাগ করেন স্বেচ্ছায়। শ্যামগঞ্জ লবণ আইন অমান্য ও চেঁচুয়ায় ভোলা দারোগা হত্যাকাণ্ডের অগ্রণী কর্মী। ভোলা দারোগাকে হত্যার সময় হত্যাকারীদের নাম যে ডায়েরিতে এস.আই অনিরুদ্ধ সামন্ত লিখেছিলেন তা প্রত্যক্ষ করে তিনি তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। বিচারে দ্বীপান্তরের আদেশ হয়, আপিলে মুক্তি পান। ১৯৩২ এ চেঁচুয়ায় শহীদ দিবস উদযাপনের অপরাধে ৬ মাস দমদম সেন্ট্রাল জেলে কারারুদ্ধ থাকেন।
পার্বতীচরণ ঘোষ
১১ আগষ্ট ১৯০৮, ফাঁসিতে ক্ষুদিরামের আত্মত্যাগ। এই দিন থেকে ঘাটালের বৈপ্লবিক স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্রপাত। এর পিছনে ছিলেন তখন ঘাটাল বিদ্যাসাগর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পার্বতীচরণ। তাঁর নির্দেশে ১১ আগস্ট ছাত্র-শিক্ষকরা নগ্নপদে বিদ্যালয়ে আসেন এবং প্রথম ঘন্টার পর বিদ্যালয় ছুটি দিয়ে দেন। ঘটনাটি ব্রিটিশ প্রশাসনের দৃষ্টি কাড়ে।
বঙ্কিম চন্দ্র শাসমল
জন্ম ১ সেপ্টেম্বর ১৯১২ দাসপুরের সয়লা গ্রামে। পিতা কৃত্তিবাস, মাতা সুভাষিনী দেবী। সোনাখালি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। হুগলীর ভাঙড় হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন এবং পরে সোনাখালী হাইস্কুলে আসেন। এম. এ পাশ করার পর রাজনগর ইউনিয়ন ও পরে পাঁচগেছিয়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে কাজ করার পর অবসর নেন। গান্ধীজির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯৩০ এ এলাকার লবণ সত্যাগ্রহে তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল। বিলাতী কাপড় পোড়ানোরও তিনি সক্রিয় কর্মী। গ্রামে গ্রামে চরকা সংগ্রহ, চরকা সংস্কার, কাপড় তৈরি ইত্যাদি কাজ করতে গিয়ে পুলিশের কোপে পড়েন। নেতৃত্বের নির্দেশে তিনি আত্মগোপন করেন। ১৯৬৭ খ্রি. দাসপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে তিনি জয়ী হন। ‘স্বরাজ ও সংগঠন’ সংবাদপত্রের তিনি আজীবন সম্পাদক ছিলেন। মৃত্যু ২৮ আগস্ট ২০০২।
বিনোদবিহারী বেরা
জন্ম ১৮৯৬ খ্রি. সোনাখালি গ্রামে। পিতা চিন্তামণি। তিনি থানার বিভিন্ন ইউনিয়নে কংগ্রেস কমিটি গঠন করে ১৯২০ খ্রি. থেকে চরকা ও খাদি আন্দোলনের সূচনা করেন। তিনি আজুড়িয়া মদ দোকান ধ্বংস মামলায় অভিযুক্ত হয়ে ১৯২৪ খ্রি. গ্রেপ্তার বরণ করেন। দেড়মাসের জন্য কারারুদ্ধ থাকেন। ১৯৩০ খ্রি. লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশ নেন। চেঁচুয়ার দারোগা হত্যা মামলায় রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে অভিযুক্ত হয়ে কারারুদ্ধ হন।
বিনোদবিহারী সামন্ত
জন্ম ১৮৯৪ খ্রি. সাহাচক গ্রামে (দাসপুর)। পিতা হারাধন। অসহযোগ আন্দোলনের সময় বৌবাজার বাংলা প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির অফিস থেকে ডালহৌসি স্কোয়ার পর্যন্ত ১৪৪ ধারা অমান্য করে মিছিল পরিচালনার অপরাধে তিনি গ্রেপ্তার হন। রাজবন্দী হিসেবে তাঁকে ১৯২১ খ্রি. এপ্রিল মাস থেকে খিদিরপুর ডক ক্যাম্পে ১ মাস ১২ দিন কারারুদ্ধ থাকতে হয়। বিনোদবিহারী দাসপুর কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে দিল্লীতে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির বিশেষ অধিবেশনে যোগদানের অপরাধে বিচারাধীন বন্দী হিসেবে দিল্লী জেলে ১ মাস আটক থাকেন। ১৯৩২ খ্রি. আইনঅমান্য আন্দোলনের সময়ে তিনি দাসপুরে গ্রেপ্তার হন। দমদম সেন্ট্রাল জেলে ১৯৩২ খ্রি. ৬ জুন থেকে ৬ মাসের জন্য রাজবন্দী থাকেন।
বিনোদবিহারী দিন্ডা
রবিদাসপুর। ১৯২২ এ রবিদাসপুর আঞ্চলিক কংগ্রেস দলের সভাপতি। ১৯৩২ এ চেঁচুয়ার শহীদ দিবস পালন করায় ছয় মাস কারাদণ্ড ভোগ করেন।
বিহারীলাল সিংহ
কেঁচকাপুর, চন্দ্রকোনা। জমিদার পরিবারের সন্তান। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় এলাকায় বিলেতি দ্রব্য বয়কট ও স্বদেশী দ্রব্য গ্রহণ প্রচার আন্দোলনে ও কলকাতার নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।
বিজয় কৃষ্ণ সাঁতরা
জন্ম জুলাই ১৯১৫ সালে ঘাটালের নতুকে। পিতা রামরূপ। নতুক কংগ্রেসের সক্রিয় কর্মী। অসহযোগ আন্দোলনে যোগদানের কারণে পুলিশের হাতে নির্যাতন ভোগ করেন। সি. ডি আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেওয়ায় পুলিশ কর্তৃক বারবার শারীরিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়। ঘাটাল সাবজেলে এক মাস এবং মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দী থাকেন ২৭. ১.১৯৩২ - ২৫. ২.১৯৩২)। মৃত্যু ২.২.১৯৫০ ।
ভবানীরঞ্জন পাঞ্জা
ভবানীরঞ্জন পাঞ্জার জন্ম ১৩০৮ বঙ্গাব্দের ১৯ অগ্রহায়ণ কলাইকুণ্ডু গ্রামের (দাসপুর) বর্ধিষ্ণু পরিবারে। পিতা বাবুলাল, মাতা সারদা সুন্দরী দেবী। ঘাটাল পৌরসভার পর্যায়ক্রমে পৌরপিতা (১৯৪৭-৫১) ও উপ-পৌরপিতার (১৯৩৭-৪২) দায়িত্ব পালন করেন। জেলা কংগ্রেসের অন্যতম সম্পাদক ছিলেন। দাসপুর বিধানসভা কেন্দ্রে ১৯৫৮ খ্রি. কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৪২ খ্রি. ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারারুদ্ধ হন। ১৯৪৭ খ্রি. ১৫ই আগস্ট ঘাটাল থেকে সাপ্তাহিক ‘আরো আগে’ সংবাদপত্র ভবানীরঞ্জনের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। ১৯৮০ খ্রি. ৪ এপ্রিল তাঁর জীবনাবসান হয়।
ভূতনাথ মান্না
সয়লা, সোনাখালি, দাসপুর এর বাসিন্দা। তাঁর লাঠির আঘাতে ভোলা দারোগা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পুলিশকর্মী শান্তি সিং এর হাত থেকে তিনি বন্দুক ছিনিয়ে নেন। বিচারে দ্বীপান্তর হয়। প্রথম ৪-৫ বছর মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে থাকেন তারপর তাঁকে ঢাকা জেলে স্থানান্তরিত করে।
মানবেন্দ্রনাথ রায়
বিপ্লবী মানবেন্দ্রনাথ রায়ের পৈত্রিক বাসভূমি ক্ষেপুত গ্রামে (দাসপুর)। জন্ম-১৮৮৭ খ্রি. ২১ মার্চ ২৪ পরগণার আড়বেলিয়াতে। বাবার নাম দীনবন্ধু ভট্টাচার্য। মানবেন্দ্রনাথের প্রকৃত নাম নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। স্বাধীনতা সংগ্রামের কাজে বিভিন্ন সময়ে তিনি সি. মার্টিন, হরি সিং, মি. হোয়াইট, মানবেন্দ্র রায়, ডি. গার্সিয়া, ডাঃ মাহমুদ, মি. ব্যানার্জী প্রভৃতি ছদ্মনাম গ্রহণ করেন। কিন্তু মানবেন্দ্রনাথ রায় নামেই তিনি পরিচিত। মানবেন্দ্রনাথ মেক্সিকোতে সোশালিস্ট পার্টি গঠন করেন ও পরে তাকে কমিউনিস্ট পার্টিতে রূপান্তরিত করেন। রাশিয়ার বাইরে এটাই বিশ্বের প্রথম কমিউনিস্ট পার্টি। তিনি কমিউনিস্ট ইন্ট্যারন্যাশন্যালের সদস্য ছিলেন এবং লেনিন ও ট্রটস্কীর সহযোগী রূপে কাজ করেন। ১৯৩০ খ্রি. তিনি গোপনে ভারতে আসেন। র্যাডিক্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি গঠন করেন এবং কারারুদ্ধ হন। সতেরোটি ভাষায় দক্ষ ছিলেন। তাঁর রচিত ৬৭টি গ্রন্থ ও ৩৯টি পুস্তিকার সন্ধান পাওয়া গেছে। ১৯৫৪ খ্রি. ২৫শে জানুয়ারী মানবেন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়।
মৃগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য
দাসপুরের কলোড়া গ্রামে ১৯১০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা বলরাম। স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত থাকায় তিনি দশম শ্রেণীর বেশী পড়ার সুযোগ পান নি। ১৯২৮ সালে কংগ্রেসের প্রাথমিক সদস্য পদ লাভ। ১৯৩০ সালে কাঁসাই নদীর তীরে শ্যামগঞ্জে লবণ আইন অমান্য করে লবণ প্রস্তুত কর্মসূচিতে যোগ দেন। মৃগেন্দ্রনাথ চেঁচুয়ার ভোলা দারোগা হত্যা মামলার প্রধান আসামী। ১৯৩০ এ ২৫ সেপ্টেম্বর স্পেশাল ট্রাইবুনালের রায়ে তাঁর যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের আদেশ হয়। হাইকোর্টে আপিলের ফলে তাঁর ৭ বছরের জেল হয়। ১৯৩৮ এর পর কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েছেন। ১৯৫২, ১৯৬২, ১৯৬৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে দাসপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে জয়ী হন। চীন ভারত সীমান্ত সংঘর্ষের সময় তাঁকে ভারতরক্ষা আটক আইনে কারারুদ্ধ করা হয়। ১৯৭২ সালে ১৪ জুলাই ঘাটাল হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়।
মোহিনীমোহন মন্ডল
স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং মেদিনীপুর জেলায় কমিউনিস্ট পার্টির সূচনাপর্বের অন্যতম শহীদ মোহিনীমোহন মণ্ডল। তিনি ব্রাহ্মণবসানের (দাসপুর) জমিদার কৃত্তিবাস মণ্ডলের তৃতীয় পুত্র। অনুমান মেদিনীপুর কলেজ থেকে বি. এ. পাশ করেন। সোনাখালি হাইস্কুলে পড়ার সময় লবণ আইন অমান্য আন্দোলনে যোগদানের অপরাধে ৬ মাস কারারুদ্ধ থাকেন। বার্জ হত্যা মামলাতেও অভিযুক্ত হন। ১৯২১ খ্রি. জেলায় অসহযোগ আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। ১৯৩৩ এ বিচারাধীন বন্দী হিসেবে ৬ মাস আটকে থাকেন মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় জেলে। ১৯৩৪ এ BCLA ধারায় অভিযুক্ত হয়ে মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় জেলে ৪ মাস, বক্সার ক্যাম্পে ৩ মাস বন্দী থাকেন। ১৯৩৪ এর মধ্যবর্তী সময় থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত আটক থাকেন বহরমপুর ক্যাম্পে। বহরমপুর থেকে ৮.৭.১৯৩৭ এ মৈমনসিংহ জেলার একটি গ্রামে নজরবন্দী থাকার পর মুক্তি পান ও বছরের শেষদিকে।১৯৩৫ থেকে মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন। পুলিশের শ্যেনদৃষ্টি এড়িয়ে বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করে দেশের কাজ করতে গিয়ে ১৯৪২ সালে মোহিনী প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে মারা যান। কংসাবতীর পূর্বতীর পার্বতীপুরে বাঁশরী সানকীর বাঁশবনে তাঁকে গোপনে সমাহিত করা হয়।
মুরারীচরণ দিন্ডা
রবিদাসপুর, দাসপুর। ভোলা দারোগা ও এস.আই অনিরুদ্ধ সামন্তের হত্যার অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। চকবোয়ালিয়ার মাঠে চিৎমল্লিকা পুষ্করিণীর দক্ষিণ পাড়ে নিয়ে গিয়ে হত্যার জন্য অনিরুদ্ধ'এর গলায় প্রথম তিনি কুঠারাঘাত করেন। এই হত্যাকারীদের যথাযথ শাস্তি বিধানের জন্য সরকার স্পেশাল ট্রাইবুনাল গঠন করে। মামলা পরিচালনার ব্যাপারে কথা বলার জন্য তিনি কলকাতায় সাতকড়িপতি রায় এর কাছে যান। পরামর্শ করেন বীরেন্দ্রনাথ শাসমল এর সঙ্গে নেতাজি সুভাষ বসুর সাথেও। আত্মগোপন করে থাকার সময়ে মেদিনীপুরের সঙ্গতবাজার থেকে তাকে বিনোদ বেরা ও কিশোর মালকে গ্রেফতার করে।চরকা কাটা,গান্ধী স্মৃতি তহবিলের অর্থ সংগ্রহ ইত্যাদি বহু কাজে যুক্ত ছিলেন।
মানিক চন্দ্র ঘোষাল
পিতা নগেন্দ্রনাথ। কোন্নগর, ঘাটাল। স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়ে হাজার ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের কারাবরণ করেন। ৬ মাস জেল থাকেন ঘাটাল সাবজেলে। জেলাশাসক বার্জ হত্যার পর তাঁকে পুনরায় কারাবন্দি করা হয় দু মাস। পর্যায়ক্রমে.......... থাকেন তিন বছর। ঘাটাল মহকুমা থেকে বহিষ্কার করা হয়।..... থাকেন হাওড়া গোলাবাড়ি।
মন্মথনাথ চক্রবর্তী
বাড়ি সোনাখালি। বি. বি. সি. সি.র সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ১৯৩০ এ ভোলা দারোগা হত্যার পর সভা-সমিতি করার অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে 6 মাস কারারুদ্ধ থাকেন। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে চেঁচুয়া শহীদ দিবস পালনের প্রস্তাবক ও অন্যতম উদ্যোক্তা। সোনাখালি কংগ্রেস কমিটির প্রধান। সোনাখালি ও শ্যামগঞ্জ অঞ্চল নিয়ে গঠিত কংগ্রেস কমিটির সভাপতি। চেঁচুয়ার প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মহেশ দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠার প্রধান উপদেষ্টা।
মনোতোষণ রায়
জন্ম ১৮৯১ খ্রি. ঘাটালের কোন্নগরে। পিতা রমেশচন্দ্র। মনোতোষণ বিপ্লবী দলের সদস্য ছিলেন। ১৯৩০ খ্রি. ২৫ মে ১ বছরের জন্য জেলে আটক থাকেন। ১৯৪২ খ্রি. আগস্ট আন্দোলনের সময় বিট্রিশের বিরুদ্ধে পুস্তিকা বিতরণের অপরাধে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে এবং দেড় মাসের জন্য কারারুদ্ধ রাখে ঘাটাল সাব জেলে।
মোহিনীমোহন দাস
জন্ম-১৮৭৯ খ্রীস্টাব্দে রাধাকান্তপুরে (দাসপুর) করেন। পিতা অন্নদাচরণ মাতা ক্ষীরোদাসুন্দরী দেবী। তিনি ১৯২০ খ্রীষ্টাব্দে আইন ব্যবসা ত্যাগ করে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। ঘাটাল মহকুমা কংগ্রেসের সভাপতি ও জেলা কংগ্রেসের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৩০ খ্রি. থেকে সবরকমের জাতীয় আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন। ১৯৩০ ও ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে তিনি ১০ মাস কারাভোগ করেন। ঘাটাল পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন ১৯৩৮–৪২ খ্রি.। ১৯৫৮ খ্রি. ১৬ অক্টোবর কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়।
ডাঃ যতীশচন্দ্র ঘোষ
চিকিৎসক ও রাজনৈতিক কর্মী ডাঃ যতীশচন্দ্র কর্মসূত্রে ঘাটাল মহকুমার বাসিন্দা। জন্ম ১৮৯৮ খ্রি. হুগলী জেলার নকুণ্ডা গ্রামে বিত্তশালী ঘোষ পরিবারে। পিতা উমেশচন্দ্র, মাতা মঙ্গলা দেবী। কারমাইকেল কলেজ আর. জি. কর মেডিক্যাল থেকে এল. এম. এস ডিপ্লোমা করাকালীন ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের সান্নিধ্যে আসেন। ডাঃ ঘোষ স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেন। একবার জেলা থেকে বহিষ্কৃত এবং বেশ কয়েকবার কারারুদ্ধ হন।
১৯৫২ খ্রি. কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থনে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থীকে পরাজিত করে বিধানসভায় যোগ দেন। মৃত্যু হয় ১৯৬৪ খ্রি. ৮ অক্টোবর।
যোগেন্দ্র হাজরা
তাতার খাঁ, দাসপুর। অসহযোগ, লবণ আইন অমান্য আন্দোলন সহ সমস্ত আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন। লবণ আইন অমান্য আন্দোলন সফল করার জন্য দলের ক্যাপ্টেন জি.ও.সি পদ তৈরি হয়। যোগেন্দ্র ছিলেন তেমোহানির ক্যাপ্টেন।
যোগেন্দ্রনাথ রাজপণ্ডিত
বরুণা, উদয়চক, দাসপুর। সোনাখালি কংগ্রেস কমিটির অধীনে স্বেচ্ছাসেবক রূপে কাজ করেছেন লবণ সত্যাগ্রহে। কারাবরণ করেন। কারাগারে থাকাকালীন যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হন।
রেবতী রাজ পন্ডিত।
বরুনা,উদয়চক, দাসপুর। সোনাখালি অঞ্চলে স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সক্রিয় কর্মী। মানুষের মনে স্বাধীনতা স্পৃহা জাগিয়ে তোলার জন্য বিভিন্ন সভা সমিতিতে উদ্দীপনা পূর্ণ বক্তৃতা করতেন। সোনাখালি কংগ্রেস কমিটির নেতৃত্বে শ্যামগঞ্জ লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনের অন্যতম স্বেচ্ছাসেবক। লবণ উৎপাদন ও এখানকার হাটে ঘুরে তা বিক্রি করতেন পুলিশের চোখ এড়িয়ে। গ্রেপ্তার বরণ করেন।
রাধারমণ সিংহ।
গোঁসাইবাজার, চন্দ্রকোনা। গান্ধীজীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে অহিংস স্বাধীনতা আন্দোলনে নিজেকে যুক্ত করেন। কিছু দিন কারাবাসও করতে হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে কেন্দ্রীয় সরকারের ভাতা পান। পরবর্তী সময়ে চন্দ্রকোনা জিরাট হাইস্কুলে চাকরি করতেন। পুরাতত্ত্ববিদ ও আঞ্চলিক ইতিহাসবিদ হিসেবেও খ্যাতিমান।
রাম ঠাকুর।
রামজীবনপুর। অনুশীলন দলের সক্রিয় কর্মী। রামজীবনপুরের পুরাতনহাট তলায় তাঁর বাড়িতেই ছিল অনুশীলন দলের শাখা কার্যালয় ‘চিরকুমার’। তাঁর অনুপ্রেরণায় অনুশীলন দলের সক্রিয় কর্মী হয়ে উঠেছিলেন ডাক্তার সন্তোষ কুমার বারিক, রাখাল চন্দ্র সরকার প্রমুখ। মেদিনীপুর, হুগলি, বাঁকুড়া জেলা ছিল তাঁর কর্মক্ষেত্র।
রামচন্দ্র দাস।
চাউলি, সিংপুর, ঘাটাল। শহীদ ক্ষুদিরামের ঘনিষ্ঠ। তাঁর সহযোগিতায় ক্ষুদিরাম ঘাটালে আসেন সংগঠন করার সূত্রে। ক্ষুদিরামকে অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল ঘাটাল পৌরসভার ‘এ’ এলাকার জমিদার বল্লভ পাহাড়ীর সেরেস্তায়। এখানেই অন্যতম স্বাধীনতা সংগ্রামী ডাঃ যতীশচন্দ্র ঘোষের সঙ্গে ক্ষুদিরামের দেখা হয়। রামচন্দ্র ছিলেন গুপ্ত সমিতির সক্রিয় সদস্য।
ডাঃ লক্ষ্মণচন্দ্র সরকার
শালঝাটী গ্রামে (চন্দ্রকোণা) বাংলা ১৩০১ বঙ্গাব্দে জন্ম। পিতা গণেশচন্দ্র। কলকাতার হোমিওপ্যাথি কলেজ থেকে তিনি এইচ. এম. বি. পাশ করে হোমিওপ্যাথী চিকিৎসায় খ্যাতি লাভ করেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য তাঁকে ১৯৩০ খ্রি. কারারুদ্ধ হতে হয়। ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য ১৯৪২ খ্রি. পুনরায় গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি দীর্ঘদিন বীরসিংহ ইউনিয়ন বোর্ডের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং মেদিনীপুর জেলা স্কুল বোর্ডের সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৫৭ খ্রি. বিধানসভা নির্বাচনে ঘাটাল-চন্দ্রকোণা যুগ্ম কেন্দ্র থেকে লক্ষ্মণচন্দ্র নির্বাচিত হন। ১৩৬৯ বঙ্গাব্দের ৫ শ্রাবণ তাঁর মৃত্যু হয়।
শীতল ভট্টাচার্য
জালালপুর, দাসপুর। ভোলা দারোগা হত্যাকাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত। বিচারে দ্বীপান্তর হয়। প্রথম ৪-৫ বছর মেদিনীপুরের সেন্ট্রাল জেলে রাখার পর ডান্ডাবেড়ি সহ তাঁকে রাজশাহী জেলে স্থানান্তরিত করে নির্জন কক্ষে রাখা হয়।
শরৎচন্দ্র অধিকারী
জন্ম ১৮৮৪, নিশ্চিন্দিপুর। পিতা শিবনারায়ণ। ঘাটাল কংগ্রেস কমিটির সক্রিয় সদস্য। সরকারি চাকরি করতেন। ১৯২০ তে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। জাতীয় সংগীত গাওয়ার অপরাধে জেলা থেকে এক বছরের জন্য বহিষ্কৃত হন ১৯২২ খ্রীস্টাব্দে। শ্যামগঞ্জ, দাসপুরের লবণ সত্যাগ্রহে যোগ দেন। পুলিশ কর্তৃক নিগৃহীত হন এবং কারাবরণ করেন ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে।
সুকুমার সেনগুপ্ত
সুকুমার সেনগুপ্ত ৮০ বছর জীবনের প্রায় ২০ বছর জেলে আর ১৩ বছর আত্মগোপন করে কেটেছে। জন্ম ১৯১৩ খ্রি. ৫ই নভেম্বর বারাণসী জেলার (উত্তরপ্রদেশ) কাশী দেবনাথপুরে মামার বাড়ীতে। পিতা চারুচন্দ্র, মাতা বিভামণি। পুশা হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে কাকার কাছে পড়াশুনার জন্য মেদিনীপুর কলেজে আই. এস. সি. ক্লাসে ভর্তি হন। অচিরেই স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। বার্জ হত্যা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের আসামী হিসেবে আন্দামান সেলুলর সেন্ট্রাল জেলে প্রেরিত হন। সেখানেই কমিউনিস্ট ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হন। ১৯৩৮ খ্রি. কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেন। ১৯৪৬ খ্রি. ৩১ আগস্ট মুক্তি পেয়ে ঢাকা কমিউনিস্ট পার্টি অফিসে ওঠেন। ১৯৫২ খ্রি. এই মহকুমায় সংগঠন ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে ঘাটালে আসেন।
১৯৫৩ খ্রি. জমিদারী অধিগ্রহণ আইন পাশ হলে মহকুমাব্যাপী বর্গা রেকর্ড, মজুরী বৃদ্ধি ও তেভাগার অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন সুকুমার সেনগুপ্তের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের ‘বাংলা বিহার’ সংযুক্তির প্রস্তাবের বিরোধীতা করে তিনি মহকুমায় শত শত গ্রাম্য ও বড় জনসভা করেন। পার্টির জেলা সম্পাদকের দায়িত্ব লাভের অব্যবহিত পরে তিনি মেদিনীপুরে চলে যান। সুকুমার সেনগুপ্তের মৃত্যু হয় ১৯৯৩ খ্রি. ১৬ সেপ্টেম্বর।
স্বদেশরঞ্জন দাস
জন্ম রাধাকান্তপুরে (দাসপুর) ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে। পিতা স্বাধীনতা সংগ্রামী মোহিনীমোহন দাস, মাতা হেমাঙ্গিনী দেবী। স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত থাকার অপরাধে কারারুদ্ধ হন। ৬ মাস দমদম সেন্ট্রাল জেলে তাঁকে রাখা হয়। অসহযোগ আন্দোলন (১৯২১) স্বদেশী দ্রব্য বিক্রয় ও বিলাতী দ্রব্য বয়কট কেন্দ্র স্থাপিত হয়। এই আন্দোলনে পিতার সঙ্গে স্বদেশরঞ্জনও অংশ নেন। একটি মামলার স্পেশ্যাল ট্র্যাইবুন্যালে দীর্ঘ তিনমাস চুঁচুড়া আদালতে স্বদেশরঞ্জন ও হরিসাধন পাইনের বিচার হয়।
স্বদেশরঞ্জন বামপন্থী আন্দোলনেও নিজেকে যুক্ত করেন। ১৯৩২ খ্রি. ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। পরে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের নব মানবতাবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন। মানবেন্দ্রনাথকে নিয়ে তিনিই প্রথম গ্রন্থ রচনা করেন। অনেকগুলি গ্রন্থের রচয়িতা স্বদেশরঞ্জন—১. সর্বহারার দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠি। ২. মার্কসীয় ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি। ৩. রায় (মানবেন্দ্রনাথ রায় সম্পর্কিত) ৪. মানবের জয়যাত্রা ৫. Why Co-operative common wealth ৬. সমবায় আন্দোলন ৭. মানবেন্দ্রনাথ জীবন ও দর্শন ৮. মানবেন্দ্রনাথ রায় (জীবনালেখ্য) ৯. নব মানবতাবাদ (মানবেন্দ্রনাথ রায়ের নিউ হিউম্যানিজম গ্রন্থের অনুবাদ) ১০. বিপ্লবের নবকৌশল ১১. মুক্তিবাদ নীতিবাদ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ জাগানোর পদ্ধতি ইত্যাদি। দীপঙ্কর দাস ‘সারস্বত সাধনায় মেদিনীপুর’ গ্রন্থে লিখেছেন, ঘাটালের স্বদেশরঞ্জন দাস নতুন দৃষ্টিভঙ্গীর প্রকাশ ঘটান মেদিনীপুরে। সেই দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই ‘দিনমজুর’ (১৯৩২), বিশ্ববার্তা (১৯৩৫), সমবায় (১৯৪৮-৪৯) প্রভৃতি কাগজ সম্পাদনা ও প্রকাশ করতেন তিনি। হয়তো কাগজগুলো কলকাতা থেকেই প্রকাশ হত, কিন্তু উদ্যোগ ছিল মেদিনীপুরে এবং ঘাটালে এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গীর প্রভাব পড়েছিল। স্বদেশরঞ্জন ইড়পালায় বসবাস করেছেন। শেষ জীবন কেটেছে দমদমে। ১৯৭৬ খ্রি. এক বাস দুর্ঘটনায় স্বদেশরঞ্জন দাসের মৃত্যু হয়।
সাতকড়িপতি রায়
যোগেন্দ্রচন্দ্র রায়ের দ্বিতীয় পুত্র সাতকড়িপতি (১৮৮০––১৯৮৬) মেদিনীপুর কোর্টে ও পরে কলকাতার উচ্চ আদালতে ওকালতি করতেন। চাকরী ছেড়ে ১৯২০ খ্রি. গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। এই সময় সাতকড়িপতি প্রদেশ কংগ্রেসের সহ-সম্পাদক, বীরেন্দ্রনাথ শাসমল সম্পাদক ও চিত্তরঞ্জন দাস সভাপতি ছিলেন। ১৯২৩ খ্রি. বড়বাজার কেন্দ্র থেকে তিনি বঙ্গীয় ব্যবস্থা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। কলকাতা কর্পোরেশনের কাউন্সিলার ও নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৩৪-৩৫ খ্রি. গান্ধীজীর নির্দেশে সাতকড়িপতি বাংলার হরিজন সেবক সংঘের সম্পাদক হয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি পশ্চিমবঙ্গ পুনর্গঠন সংযুক্ত পরিষদের সভাপতির পদ অলংকৃত করেন।
সনাতন রায়
পিতা স্বাধীনতা সংগ্রামী কিশোরীপতি রায়। জাড়া। মেদিনীপুর কলেজে পড়ার সময় স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেন। ফলে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। অনুশীলন সমিতির পাশাপাশি ১৯২৮ এ মেদিনীপুর শহরে বি.ভি র শাখা খোলা হয়। নির্মল জীবন ঘোষের অনুপ্রেরণায় এই বি.ভি দলে যোগ দেন। বি.ভি.র সদস্যরাই ১৯৩১-১৯৩২-১৯৩৩ এ পেডি, ডগলাস,বার্জ এই তিনজন জেলাশাসককে হত্যা করে। শুরু হয় পুলিশের ধরপাকড়। ১৬ই সেপ্টেম্বর ১৯৩৩ -এ তিনি গ্রেপ্তার হন। বিচারে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয়। শুরু হয় সেলুলার জেলে তাঁর বন্দিজীবন। ১৪ এপ্রিল ১৯৩৯-এ আরও অনেকের সঙ্গে তাঁকেও মুক্তি দেওয়া হয়।
সুরেন্দ্রনাথ বাগ
জন্ম- ১৮৯৮ খ্রী., তাতার খাঁ গ্রামে। পিতা পীতাম্বর। চেঁচুয়া হাটে দারোগা হত্যা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে মেদিনীপুর ও ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে ১৯৩০-৪৬ খ্রি. পর্যন্ত যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত আসামী হিসেবে আটক থাকেন। জেলে থাকাকালীন তিনি সীমাহীন দৈহিক নির্যাতন ভোগ করেন। বিভিন্ন সময়ে সুরেন্দ্রনাথ প্রতিবাদে অনশন ধর্মঘট করেছেন।
সুরেন্দ্রনাথ অধিকারী
জন্ম ১৮৯২ খ্রি. নিশ্চিন্দীপুর গ্রামে (ঘাটাল)। পিতা তারাচাঁদ অধিকারী। ১৯২১ খ্রি. অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন এবং লবণ সত্যাগ্রহে অংশ নেন। ঘাটাল কংগ্রেস কমিটির সম্পাদক হিসেবে শ্যামগঞ্জ লবণ তৈরী কেন্দ্রের জন্য স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহ করেন। ১৯৩০ খ্রি. সুরেন্দ্রনাথের উপর পুলিশ লাঠিচার্জ করে এবং তাকে গ্রেপ্তার করে মেদিনীপুর ও সিউড়ি জেলখানায় কয়েদ রাখে। তিনি কর বর্জন ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৪২ খ্রি. পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে জেলে আটক থাকেন।
ডাঃ হরেন্দ্রনাথ দোলুই
নিশ্চিন্তপুর গ্রামে (ঘাটাল) ১৩০১ বঙ্গাব্দের ৮ জ্যৈষ্ঠ জন্ম। প্রাক্ স্বাধীনতা যুগে ঘাটালের বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ ডাঃ হরেন্দ্রনাথের পিতা উমেশচন্দ্র, মাতা এলোকেশী। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পুত্র নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহায়তায় তিনি কলকাতা থেকে বি. এ. পাশ করেন ও হোমিওপ্যাথিতে ডিগ্রী নিয়ে ঘাটালে চিকিৎসা শুরু করেন। হরেন্দ্রনাথ লবণ সত্যাগ্রহ ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশ নেন। বৃটিশ আমলে তিনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য এবং ১৯৩৯ খ্রি. ঘাটাল পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ খ্রি. অন্নদাপ্রসাদ চৌধুরীর সঙ্গে যুগ্মভাবে বঙ্গীয় ব্যবস্থা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৭ খ্রি. ঘাটাল-চন্দ্রকোণা বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি পূর্ত বিভাগের পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী (১৯৪৭–৫২) ছিলেন। ডাঃ দোলুই জেলা বোর্ড, স্কুল বোর্ড, জেলা কংগ্রেস কমিটি ও পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন। গ্রামে মায়ের নামে ‘এলোকেশী দাতব্য চিকিৎসালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৩৮৬ বঙ্গাব্দের ১৯ মাঘ হরেন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়।
হরিসাধন পাইন
জন্ম কোন্নগরে, ১৩০৬ বঙ্গাব্দে। তরুণ বয়সে ঘাটাল টাউন ক্লাবের রাইট-ব্যাক পজিশনের বিখ্যাত ফুটবল খেলোয়াড়। সুবক্তা হরিসাধন কবিতা রচনাতেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন। কংগ্রেসের এক সভায় সুভাষচন্দ্র বসু ঘাটালে এলে হরিসাধন ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে একটি স্বরচিত ব্যঙ্গ কবিতা আবৃত্তি করেন। মহকুমায় লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে তিনি প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। স্বদেশীরা ঘাটাল ডাক বাংলো পোড়াবে ও ট্রেজারী লুঠ করবে এই অভিযোগে ১৯৪২ খ্রি. অন্যদের সঙ্গে হরিসাধনও গ্রেপ্তার হন। ঘাটাল পৌরসভার নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। আজীবন কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বহু কবিতা স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত। সাপ্তাহিক ‘আমার দেশ’ পত্রিকার তিনি সম্পাদক ছিলেন। ১৩৭৯ বঙ্গাব্দের ৪ঠা ফাল্গুন হরিসাধনের মৃত্যু হয়।
হৃষিকেশ পাইন
জন্ম ১৮৮৯ খ্রি. দাসপুর থানার পাইকান দুর্যোধন গ্রামে। পিতা গোপীনাথ। হৃষিকেশ সরকারী চাকুরী ত্যাগ করে লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯৩০ খ্রী. পুলিশ গ্রেপ্তার করে। আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দেওয়ার অপরাধে পুনরায় ১৯৩২ খ্রীঃ গ্রেপ্তার করে পুলিশ হৃষিকেশকে দমদম জেলে কারারুদ্ধ রাখে।