নবাব মীরকাসিম ও ইংরেজ শাসক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সন্ধির শর্ত হিসেবে পাশাপাশি দুটি চাকলা, চাকলা বর্ধমান ও চাকলা মেদিনীপুর কোম্পানির হস্তগত হয়। পরবর্তী চাকলা হিজলির তমলুক ও চেতুয়া পরগনার ভৌগোলিক ও আর্থসামাজিক সাদৃশ্য তে প্রচুর মিল ছিল। পরগনা গুলি নদী বেষ্টিত হওয়ায় কৃষি ও লবণ শিল্পের হাত ধরে অর্থনৈতিক বুনিয়াদ ছিল বেশ শক্ত। ১১৫ পরগনার চাকলা মেদিনীপুরের ১২ নং ইউনিয়ন বোর্ডের অন্তর্গত শ্যামগঞ্জ। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল মহকুমার দক্ষিণ পূর্ব সীমার দুর্বাচটি খালের পশ্চিম পাড়ে অবস্হিত শ্যামগঞ্জ গ্রাম। এই বোর্ডের সভাপতি ছিলেন শীতল চন্দ্র করণ। চেতুয়া ও মঙ্গলঘাট পরগনার জীবিকার মুখ্য উৎস ছিল কৃষি ও লবণ উৎপাদন। পরম্পরাগত ভাবে এখানকার মানুষের এটাই বৃত্তি। পারাঙ, বুড়ি গাঙ ও কুবাই এর জল শিলাবতীর সঙ্গে মিশে দ্বারকেশ্বরের জলপ্রবাহ নিয়ে রূপনারায়ণ নদ। এই নদে নিয়মিত জোয়ার ভাটার ফলে জোয়ারের নোনা জল পরগনা গুলিতে প্রবেশ করত। ভাটার জল সরে গেলে তীরবর্তী এলাকায় সাদা মাটির প্রলেপ পড়ত। বিগত কয়েক শতক ধরে চাকলা হিজলীর গেঁওখালি থেকে চেতুয়া পরগনার রানিচক পর্যন্ত বেশিরভাগ মানুষই লবণ শিল্পের সাথে পরম্পরা গত ভাবে যুক্ত ছিল। অনেক গরীব গুর্বোরা এভাবেই তাঁদের জীবিকা নির্বাহ করতেন। এই লবণ তৈরি বেশ কষ্টসাধ্যও ছিল। রূপনারায়ণ এর জোয়ারের টানে আসা ওই সাদা প্রলেপ কে সাবধানে তুলে এনে জলীয় অংশ কে তাপের মাধ্যমে বাষ্পীভূত করে লবণাম্বু তৈরি হত। ওই লবণ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ ছাড়াও কলকাতার লবণ ব্যবসায়ীরা ক্রয় করতেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কিছু এজেন্ট সুদূর লিভারপুল থেকে লবণ আনিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। এদেশের লবণ শিল্প উৎখাত করানোর জন্য চক্রান্ত করে কোম্পানিকে দিয়ে কুখ্যাত লবণ আইন তৈরি করানো হয়। এই ঘটনা ক্রমে ১৯৩০ সালে মার্চ মাসে কংগ্রেসের কার্যনির্বাহী কমিটি অসহযোগ ও লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনের অনুমতি প্রদান করে। লবণ আইন আন্দোলনের অবিসংবাদী নেতা গান্ধীজি বিখ্যাত সবরমতী আশ্রম থেকে ৭৯ জন সঙ্গী নিয়ে ১২ ই মার্চ ডান্ডি অভিযান শুরু করেন। দীর্ঘ চারশত কিমি পথ অতিক্রম করে ২৬ দিনে ৬ ই এপ্রিল যাত্রা শেষে ডান্ডি তে পৌঁছন এবং লবণ তৈরি করে লবণ আইন ভঙ্গ করেন। এই যাত্রাকালের মধ্যে বিশেষ করে চাকলা মেদিনীপুর ও চাকলা হিজলী এর তমলুক পরগনাতে বিশেষ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এর বিশেষ কারণ মেদিনীপুর হল শহীদ ক্ষুদিরাম এর জন্মভূমি। তাঁর আত্মবলিদানের প্রভাব ছাড়াও এম.এন রায়, প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য, মোহিনী মণ্ডল, মৃগেন ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গোটা মেদিনীপুর উত্তাল হতে থাকে। শ্যামগঞ্জের লবণ আইন আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিপ্লবীদের ইংরেজদের বিরুদ্ধাচরণ ও শক্তি প্রদর্শন ইংরেজদের মেদিনীপুরের ভীত নাড়িয়ে দেয়। এমনকি এই ঘটনার তীব্রতা সুদূর ইংল্যান্ডের আইনসভাতেও বিষয়টি আলোচনা হয়। শাসক প্রমাদ গুনে উপলব্ধি করেন এই জেলাকে যদি ঠিকমতো শাসন করা না যায়, স্বাধীনতা সংগ্রামীগণ একদিন ব্রিটিশ শাসন উচ্ছেদ করে স্বাধীন ভারতবর্ষ গঠনে সফল হবে। গান্ধীজির ডান্ডি যাত্রার শুরু ১২ ই মার্চ ঠিক ১ সপ্তাহের মাথায় ১৯ এ মার্চ মেদিনীপুরে লবণ সত্যাগ্রহ কর্মসূচির রূপরেখা তৈরির জন্য সভা আহুত হয়। সেই সভায় পায়ে হেঁটে ঘাটাল ও দাসপুর থানা থেকে বহু মানুষ যোগদান করেন। বাঁকুড়া জেলা গান্ধীজির সত্যাগ্রহী সঙ্গী ৭৯ জন এর সংখ্যাটি মাথায় রেখে ৭৯ জন এর সত্যাগ্রহী দল নিয়ে কাঁথির সমুদ্র তীরবর্তী ২০ টি গ্রামে লবণ আইন অমান্য করে প্রফুল্ল ঘোষ এর নেতৃত্বে লবণ তৈরি করেন। পুলিশ এঁদের গ্রেপ্তার করে বিচারে সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। সারা মেদিনীপুর জুড়ে সভা সমিতি নিষিদ্ধ করা হয়। এর প্রতিবাদে নরঘাটে দুই শতাধিক মহিলা সহ আট হাজার মানুষের মিছিল সংঘটিত হয়। এই মিছিল থেকে ধ্বনিত হয়, লবণ তৈরির চৌকিদারি ট্যাক্স বর্জন করতে হবে, সেই মিছিল সামলাতে পুলিশ ব্যর্থ হয়। মেদিনীপুর গ্রন্থে তরুণদেব ভট্টাচার্য লিখেছেন
" ধানের গোলায় আগুন দেওয়া, মেয়েদের মারধোর লাঠি ও গুলি চালনা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। পটাশপুরে গুলি চালানোর ফলে মারা গেলো দুজন, প্রতাপ দীঘির কাছে একটি গ্রামে শঙ্খ কারখানা ভেঙে তছনছ করে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হল। পিংলা থানার জানা বাড়িতে চড়াও হল পুলিশ, তার স্ত্রী তখন অন্তঃসত্ত্বা তবুও তাকে রেহাই দিল না। মারধোর করলো, শঙ্খ বাজাতে ছুটে গেলো হাজার খানেক লোক। পুলিশ ভয় পেয়ে লাঠি চালালো। শেষে গুলিতে নিহত হলো দশ জন, আহতের সংখ্যা ২৬।"
১৯২৯ সালের কিছু পূর্ব থেকেই দাসপুর থানার সোনাখালী উচ্চবিদ্যালয়ে বেশ কিছু স্বাধীন চেতনার শিক্ষিত যুবক আন্দোলনে সামিল হলেন। গোটা দাসপুর জুড়ে স্বদেশী আন্দোলনে নতুন নতুন জায়গার নাম যুক্ত হতে থাকে। উল্লেখযোগ্য হল সোনাখালী, খেপুত, চককিশোর, রানিচক, চেঁচুয়া, গোপীগঞ্জ, শ্রীবরা, জ্যোতঘনশ্যাম, কলোড়া, বাসুদেবপুর, মহিষঘাটা, রধাকান্তপুর, মানুয়া, দুধকোমরা, রবিদাসপুর, গৌরা, নন্দনপুর সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় স্বেচ্ছাসেবকে নাম নথিকরণের নেতৃত্ব দিলেন কানন গোস্বামী ও দ্বিজেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ।
গণজাগরনে স্লোগান উঠলো স্বাধীনতা আনতে হবে নতুবা ফাঁসি কাঠে ঝুলতে হবে। ১৯৩০ এ গান্ধীজী লবণ আইন অমান্যের ডাক দিলে সমগ্র মেদিনীপুর জেলার সাথে সাথে দাসপুরের শ্যামগঞ্জ এবং ঘাটালের হরিশচন্দ্রপুরকে বেছে নেওয়া হয় লবণ তৈরীর ক্ষেত্র হিসেবে। ভৌগোলিক কারণে লবণ তৈরীর যে সুবিধে এখানে ছিল বিপ্লবীরা সেটিকে কাজে লাগান এবং এখানে উৎপাদিত লবণ বিক্রির কেন্দ্র হিসেবে ঘাটাল বাজার ও দাসপুরের চেঁচুয়া হাটকে বেছে নেওয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে পুলিশি ধরপাকড় ও অত্যাচারে হরিশ্চন্দ্রপুরের লবণ তৈরী কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু পুলিশি অত্যাচারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শ্যামগঞ্জে বিপুল উৎসাহে চলতে থাকে এই লবণ তৈরী। এখানে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন সুরেন্দ্র নাথ অধিকারী, মৃগেন ভট্টাচার্য, যোগেন হাজরা, বিনোদবিহারী বেরা, অরবিন্দ মাইতি, মন্মথ চক্রবর্তী, কানন বিহারী গোস্বামী প্রমুখেরা।
১৯৩০ সালের ৭ ই এপ্রিল শ্যামগঞ্জে লবণ আইন আন্দোলনের শুরু হয়। লবণ সত্যাগ্রহীদের যারা অভ্যন্তরীণ ভাবে সাহায্য করতেন তাদের রাজরোষের ঝুঁকি ছিলই। তাছাড়াও স্থানীয় বিশ্বাসঘাতকদের চোখ এড়িয়ে খুৎ কাতর সত্যাগ্রহীদের জন্য গোপনে এগিয়ে এলেন নিরঞ্জন মাইতির পিতামহ মহেন্দ্র মাইতি ও সৌদামিনী দেবী। আর এক ষাটোর্ধ্ব মহিলা গৌরী পাল। যিনি বুড়িমা নামে খ্যাত ছিলেন। তিনি বিপ্লবীদের আশ্রয় দেওয়া থেকে পুলিশি অত্যাচার থেকে সংগ্রামীদের রক্ষা করা পর্যন্ত সমস্ত করে গেছেন। তাঁর একটি প্রমীলা বাহিনী ছিল। তাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ভোলা দারোগার বিরুদ্ধে চোরা গপ্তা আক্রমণ চালাতেন। তাঁর নেতৃত্বে স্থানীয় ভূসিমাল ও কাপড় ব্যবসায়ী ধরণী দাস ও অতুল দাস যাঁরা স্হানীয় পুলিশের চর হিসেবে কাজ করত তাদের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য কানধরে উঠ বস করিয়েছিলেন ও দোকানে আগুন লাগানোও হয়। কিছু মানুষের শুরু করা আন্দোলন হাজার হাজার মানুষকে আন্দোলনের পথে এনেছিল। তৎকালীন গুপ্তসমিতি গুলিও এই আন্দোলনে গতি এনেছিল। শাসক শ্রেণী প্রমাদ গুনলো। আন্দোলন স্তব্ধ করার জন্য প্রশাসন নির্দেশ জারি করে। সেই নির্দেশ অমান্য করে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হলো। শুরু হলো ব্রিটিশদের অত্যাচার। নিষ্ঠুর অত্যাচারী দারোগা ভোলানাথ ঘোষের নেতৃত্বে ধরপাকড় ও শারীরিক অত্যাচার শুরু হয়। লবণ তৈরির সময় অহিংস আন্দোলনকারীদের বেত্রাঘাত, বন্দুকের বাঁট দিয়ে আঘাত ছাড়াও ব্যাপক ধরপাকড় চললো। দোকানে দোকানে ফরমান জারি হলো, আন্দোলনকারীদের কোনো প্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রয় করা চলবে না। আন্দোলনকারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠলো। শত বাধা উপেক্ষা করে লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন চলতে থাকল।
১৯৩০ এ ৩ ও ৬ জুনের চেঁচুয়ার হাটের ঘটনার কারণে এই লবণ আইন আন্দোলনের প্রথম সারির নেতারা গ্রেপ্তার হলেন এবং স্থানীয় মানুষদের ওপরও ইংরেজদের অকথ্য শাসন চলতে থাকলে এই লবণ আইন আন্দোলন ভাটা পড়ল ক্রমে ক্রমে তা বন্ধ হয়ে এলো।
এই আন্দোলনে যেমন শ্যামগঞ্জের পুরুষরা যুক্ত ছিলেন, একইভাবে গ্রামের মহিলাদেরও কৃতিত্ব ছিলো অনেকখানি। বুড়িমার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা প্রমিলাবাহিনীর উদ্দেশ্যে জওহরলাল নেহেরু বলেছিলেন– দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মহিলা উপস্থিত করেছেন আমরা তা ভুলতে পারি না।
শ্যামগঞ্জের মতো প্রত্যন্ত গ্রাম এই লবণ আইন আন্দোলনে যে বীরত্ব, তেজস্বীতার এবং স্বদেশপ্রেমের পরিচয় রেখেছিল ইতিহাসের পাতায় তা বিলীন হয়েও হারিয়ে যাইনি বিস্মরণের অতলে। এই কারণেই শ্যামগঞ্জের এই আন্দোলনের গুরুত্ব স্বাধীনতা আন্দোলনেও অনেকখানি তাৎপর্যপূর্ণ।