আগস্ট মাস ভারতের স্বাধীনতার মাস। এই আগস্টে ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তি একটা সময়ের মাপকাঠি। স্বাধীনতা প্রাপ্তির ইতিহাস বর্ণে বর্ণে আন্দোলনের ধারাবাহিক ঘটনার স্থান, কাল ও ব্যক্তি বিশেষের উপর নির্ভর করে সংঘটিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, সমগ্ৰ ইতিহাস ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চল বা সীমার মধ্যে আবদ্ধ থেকেও লক্ষ্যপূরণের উদ্দ্যেশে রওনা হয়েছে। এইসব সীমায়িত এলাকার আন্দোলনের ধারাবাহিক ইতিহাস নিয়েই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বৃহৎ ইতিহাস তৈরী। একটা ক্ষুদ্র অঞ্চল বা এলাকায় আন্দোলনের নেতৃত্বে বর্ধিষ্ণু জমিদার বা সামন্ত শ্রেণির ভূমিকা উপেক্ষা করা যায় না। কোনো বৃহৎ ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইতিহাসের সমষ্টিতে। তেমনই স্বাধীনতা আন্দোলনে ঘাটাল মহকুমার জমিদার ও সামন্তদের ভূমিকার ইতিহাস ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসের মূল স্রোতে লীন হয়ে গেছে।
১৭৫৭ - র ২৩ জুন ; বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার ইংরেজ বনিকের হাতে পরাজয়ের সাথে সাথে বাংলা তথা ভারতের স্বাধীনতার দীপ নির্বাপিত হল পরোক্ষভাবে। এরপর ১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দে মিরকাশিম নবাবী পদ পাওয়ার বিনিময়ে গভর্নর ভ্যান্সিটার্টের শর্তানুসারে চট্টগ্রাম, বর্ধমান ও মেদিনীপুরের জমিদারির দায়িত্ব কোম্পানীর ওপর ন্যাস্ত করলেন। সেই সময় চাকলা মেদিনীপুর গঠিত হয়েছিল চুয়ান্নটি পরগনা নিয়ে। তখন বর্তমান ঘাটাল মহকুমার সমগ্ৰ ভূ-ভাগ বর্ধমানের অধীন ছিল। ১৭৯৩ খ্রীষ্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর কর্ণওয়ালিশ দেওয়ানী বিচার ব্যবস্থাকে রাজস্ব প্রশাসন থেকে পৃথক করেছিলেন। দেওয়ানি বিচারের ক্ষেত্রে তিনি সবচেয়ে নিম্ন আদালতে মুন্সেফ ও সদর আমীন; তার উপর তার উপর জেলা আদালতে জজ, তার উপর প্রাদেশিক আদালতে সপরিষদ গভর্নর জেনারেল দ্বারা বিচার পরিচালনা করার ব্যবস্থা করেছিলেন। ইতিপূর্বে জমিদারদের হাতে ছিল স্থানীয় প্রশাসনের ভার। তিনি সে দায়িত্ব থেকে জমিদারদের রেহাই দিয়ে দারোগার অধীন বিভিন্ন থানা স্থাপন করলেন। সেই সূত্রে ঘাটাল মহকুমার থানাগুলি প্রয়োজনের তাগিদে সময় বিশেষে স্থাপিত হয়েছিল। এছাড়াও ঘাটাল মহকুমার মধ্যে রামজীবনপুর, কাশীগঞ্জ, কলমীজোড় প্রভৃতি স্থানে এককালে থানা স্থাপিত হয়েছিল। ১৮২৯ খ্রীষ্টাব্দে রেভিনিউ কমিশনারের পদ সৃষ্টি হওয়ার পর মেদিনীপুর জেলা বর্ধমান বিভাগের কমিশনারের অধিকারভুক্ত হয়। ঘাটাল ও চন্দ্রোকনা থানার ফৌজদারীর কাজ ১৮২৬ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত হুগলীতে এবং পরে মেদিনীপুরে সম্পন্ন হত। ১৮৪৫ খ্রীষ্টাব্দে ক্ষীরপাই মহকুমা স্থাপিত হলে ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষ ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত হয়েছিলেন। ১৮৪৬ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাসে ক্ষীরপাই থেকে মহকুমা কার্য্যালয় জাহানাবাদে (আরামবাগ) উঠে যায়। ১৮৫০ খ্রীষ্টাব্দে ঘাটাল মহকুমা সৃষ্টি হয়।
ব্রিটিশ প্রশাসনের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কার্যকারিতার ধারাবাহিকতায় ঘাটাল মহকুমা গঠিত হলেও তার ভূ-খণ্ডের মধ্যে নানান জনপদ গড়ে উঠেছিল। যার কেন্দ্রে ছিল জমিদার ও সামন্ত শ্রেণী। ভারতের বুকে বিভিন্ন রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে জমিদার ও সামন্তদের অধিকার খর্ব হলেও নিজের বুদ্ধি ও দূরদর্শীতায় আধিপত্য বজায় রাখে। ব্রিটিশ সরকারের অধীনে থেকেও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির মোকাবিলা করছে বা সক্রিয় অংশগ্ৰহণের মাধ্যমে স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাঁরাও অংশগ্রহণ করেছে। সেইদিক থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঘাটাল মহকুমার জমিদার ও সামন্ত শ্রেনীর ভূমিকা ইতিহাসের উজ্জ্বল অধ্যায়।
শুধু ঘাটাল মহকুমার ভৌগোলিক ও প্রশাসনিক ভূখণ্ডের মধ্যেই নয় তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের উপরও প্রভাব ফেলেছিল। যেমন ১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার শাসনকালে 'সিলভার জুবিলি উৎসব ' উপলক্ষে নাড়াজোলের জমিদার মহেন্দ্রলাল খান 'রাজা' উপাধিতে ভূষিত হওয়ার পূর্ব থেকেই দেশহিতৈষী জমিদার হিসাবে পরিচয় পাওয়া যায়। ১৭৫৫ খ্রীষ্টাব্দে কর্ণগড়ের শেষরাজা অজিত সিংহের মৃত্যু হলে তার জমিদারি বজায় রাখতে ত্রিলোচন খান চুয়াড় বিদ্রোহ দমন করেন এবং পরবর্তী সময়ে ইংরেজ কর্ণগড় অধিকার করতে সচেষ্ট হলে নাড়াজোলের জমিদার তা প্রতিহত করেন। এখান থেকেই শুরু নাড়াজোল রাজ পরিবার তথা জমিদার বংশের ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের শুরু। অবিভক্ত মেদিনীপুরের ব্রিটিশ বিরোধীতায় সাহসিকতা ও দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছিলেন নাড়াজোলের জমিদার সীতারাম খান ও কর্ণগড়ের রাণী শিরোমণি। কিন্তু ১৭৮৮ খ্রীষ্টাব্দের পর ১৮৯৫ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত নাড়াজোলের জমিদারেরা প্রত্যক্ষভাবে ব্রিটিশ সরকারের বিরোধিতা করননি। কারণ তারা বুঝেছিলেন বৃহৎ জমিদারীত্ব রক্ষার জন্য সরাসরি বিরোধিতা না করে বাইরে ব্রিটিশ সরকারের গুণগ্ৰাহী হয়ে তাঁদের পিঠেই ছুরি চালাতে হবে। তাই অযোধ্যারাম ও মহেন্দ্রলাল খান রাজা উপাধি গ্ৰহণ করেও ভিতরে ভিতরে দেশের পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্তির সাধনায় মগ্ন বিপ্লবীদের আর্থিকভাবে সাহায্য করতেন। পরবর্তীকালে নরেন্দ্রলাল খান ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া রাজা উপাধি গ্ৰহন করেও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক যোগ্য নেতা হয়ে উঠেছিলেন। নাড়াজোলের জমিদারিত্বের অধীন মেদিনীপুরের জমিদারি ন্যাস্ত থাকার কারণে মহেন্দ্রলাল খানের সময় থেকেই মেদিনীপুর শহরে স্বদেশীভাণ্ডার গড়ে ওঠা, পাহাড়ীপুরে 'স্বদেশসমিতি', নবীনবাগের 'বসন্তমালতীর আখড়া', বড়বাজারে 'সনাতন সমিতি', ও জেলার বিভিন্ন জায়গায় গুপ্ত সমিতির গোপন আখড়ার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন নাড়াজোলের জমিদার। ১৯০৫ এর ১৭ই অক্টোবর বঙ্গভঙ্গের বিরোধীতা করে রাজা নরেন্দ্রলাল খান তার জমিদারির মধ্যে সমস্ত দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। ১৯০৬ ; ২১শে জুলাই রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ঘাটাল শহরে বক্তৃতা দিতে আসেন। এবং এই দিনে ১৩ হাজার শ্রোতাদের মধ্যে অপূর্ব উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল কৃষ্ণকুমার মিত্র, বিহারীলাল সিংহ, তিনকড়িপতি রায় ও রাজা নরেন্দ্রলাল খানের বক্তব্য। নাড়াজোল বাজারে বিদেশী জিনিস বিক্রি বন্ধের নির্দেশ দেন। ১৯০৮ এ নরেন্দ্রলাল সন্দেহবশত ব্রিটিশ পুলিশের হাতে গ্ৰেপ্তার হলে হাজার হাজার মানুষ নরেন্দ্রলালেল মুক্তির দাবিতে মেদিনীপুর জেলা আদালতে হাজির হয়। ১৯২০ খ্রীষ্টাব্দে নরেন্দ্রলাল খানের মৃত্যু হলে দেবেন্দ্রলাল জমিদারির দায়িত্ব গ্ৰহণ করলেও পিতার কাছে স্বদেশ মন্ত্রে দীক্ষিত হওয়ার কারণে বিপ্লবী আন্দোলনের প্রতি তার পূর্ণ সমর্থন ছিল। ১৯২৯ খ্রীষ্টাব্দে মেদিনীপুরের 'যুব সংঘের’ ডাকে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু মেদিনীপুর এলে পরিমল রায়, হরিপদ ভৌমিক, প্রফুল্ল ত্রিপাঠি, ব্রজকিশোর চক্রবর্তীদের সাথে দেশপ্রেমের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিলেন নাড়াজোল জমিদার পরিবারের রবীন্দ্রলাল খান । এরপর ১৯৩০ - এ গান্ধীজির নেতৃত্বে সত্যাগ্ৰহ আন্দোলন মেদিনীপুরে চরম আকার ধারণ করলে শহর জুড়ে ১৪৪ ধারা জারি হয়। ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে মেদিনীপুরের আন্দোলনকারীরা আন্দোলন জোরদার করার লক্ষ্যে বিভিন্ন সভা সমিতির মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। ফলস্বরূপ দেবেন্দ্রলাল খান গোপগড়ের নিকট কাছারি বাড়ির প্রাঙ্গণে সভার আয়োজন করে জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী, ক্ষেমঙ্করী রায়, শান্তি দাস ইন্দিরা দেবী সহ অনেক মহিলা নেত্রীদের দিয়ে সভায় বক্তব্য রাখার ব্যবস্থা করেন। দেবেন্দ্রলাল তখন মেদিনীপুরের কংগ্ৰেস কমিটির সভাপতি। সামগ্ৰিক জেলা জুড়ে ব্রিটিশ সরকারের অত্যাচার ও নিপীড়নের বর্ণনা মহাত্মা গান্ধী ও জহরলাল নেহেরুকে চিঠির মাধ্যমে তুলে ধরেন। সেই প্রেক্ষিতে গান্ধীজি মেদিনীপুর বাসীকে অভিবাদন জানিয়ে বিবৃতি পাঠালেন দেবেন্দ্রলালকে। সেই বিবৃতিতে লেখা হল ;- 'I tender my congratulation for your courage and patience with which you have borne out such sufferings with a nation pulsating with life.'
এরপর ১৯৩৮। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু জাতীয় কংগ্রেস ও বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হলে ঐ বছরের ১৭ই মে নেতাজী মেদিনীপুর শহরে আসেন ও সভাশেষে দেবেন্দ্রলালের গাড়িতেই নাড়াজোলের রাজবাড়িতে পদার্পণ করেন। ১৯৪০ খ্রীষ্টাব্দের ১২ই মে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ঝাড়গ্ৰামের 'দুর্গা ময়দানে' -র সভায় বক্তব্য রাখার ব্যবস্থা ও সভার আয়োজন করেন দেবেন্দ্রলাল খান ঝাড়গ্ৰামের জমিদারদের সক্রিয় বিরোধিতা সত্ত্বেও। এরপর ১৯৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় নাড়াজোল , মেদিনীপুর, ঘাটাল, কেশপুর প্রভৃতি জায়গায় স্বাধীনতাকামী আন্দোলনকারীদের নেতৃত্বে নাড়াজোলের জমিদার পরিবারের সদস্যরাই মূল দায়িত্ব পালন করেন। এদের মধ্যে রবীন্দ্রলাল খান, বারীন্দ্রলাল খান ও যতীন্দ্রলাল খানের ভূমিকা অপরিসীম।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে ঘাটাল মহকুমার জাড়ার জমিদার রায় পরিবারের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। যতদূর জানা যায় জাড়ার জমিদার পরিবারের সদস্য যোগেন্দ্রচন্দ্র রায় মেদিনীপুরে ওকালতি শুরু করা থেকে কংগ্ৰেসের সমর্থক ছিলেন। ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে কংগ্ৰেস প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় থেকেই প্রতিবছর কংগ্ৰেসের প্রতিনিধি হয়ে কংগ্রেসের অধিবেশনে যোগ দিতেন। সেই ধারাবাহিকতায় এই জমিদার পরিবারের পরবর্তী সদস্য মণীন্দ্রনাথ রায়, কিশোরীপতি রায় এবং সাতকড়িপতি রায় দেশসেবা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেন। মণীন্দ্রনাথ গড়বেতায় , কিশোরীপতি মেদিনীপুরে ও সাতকড়িপতি রায় কোলকাতার হাইকোর্টে ওকালতি করতেন। ১৯২৯ খ্রীষ্টাব্দে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে সাতকড়িপতি রায় হাইকোর্টের আইন ব্যবসা ছেড়ে আন্দোলনের পুরভাগে দাঁড়িয়ে মেদিনীপুর জেলায় কংগ্রেস গঠনের দায়িত্ব পালন করেন এবং মেদিনীপুর সদর মহকুমার দায়িত্ব কিশোরীপতি রায় গ্ৰহণ করে খালি পায়ে ঘুরে ঘুরে কংগ্রেস সেবাদলের কাজ করতে থাকেন। সে সময় জেলা কংগ্রেস কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমল এবং সম্পাদক ছিলেন কিশোরীপতি রায় । ১৯৩৭ খ্রীষ্টাব্দে কংগ্রেস যখন নতুন আইনের আওতায় নির্বাচনদ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হয়, তখন কিশোরীপতিবাবু ঘাটাল ও ঝাড়গ্ৰাম মহকুমা নিয়ে গঠিত নির্বাচন কেন্দ্রে সরকার পক্ষের প্রার্থী ঝাড়গ্ৰামের রাজাকে পরাজিত করে (এসেমব্লীতে) কংগ্রেস পক্ষে নির্বাচিত হন। কিশোরীপতি রায় ও সাতকড়িপতি রায় সর্বস্ব পণ করে ভারতের স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্ৰহণ করেন। সাতকড়িপতি রায় ঝাড়গ্ৰামে সাঁওতাল ও মাহাতো সম্প্রদায়কে একতাবদ্ধ করে সংগঠনকে সুদৃঢ় করেন। শিলদা পরগনার কংগ্রেস কার্য্যালয়ের ভার সাতকড়িপতি রায় দিয়েছিলেন তার ভ্রাতুষ্পুত্র মুরারীপ্রসাদের উপর। সাতকড়িপতি রায়ের নির্দেশে একদিনে দশহাজার সাঁওতালদের সমাবেশ হত। ঝাড়গ্ৰাম মহকুমায় তাঁর এত প্রভাব ছিল যে তদানীন্তন অ্যাডিশন্যাল জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পেডি সাহেব তাঁকে ও তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রকে এখান থেকে সরাবার চেষ্টা করেও সফল হননি। ঘাটালের মোহিনীমোহন দাস, মনোতোষ রায় সহ অনেকেই ওকালতি ছেড়ে সাতকড়িপতি রায়কে সাহায্য করতেন। তাঁর আশ্চর্য সাংগঠনিক ক্ষমতার জন্য ঘাটাল মহকুমার সদগোপ, মাহিষ্য এবং বাগদি সকলেই সাড়া দিয়েছিল। বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের নেতৃত্বে ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দে ইউনিয়ন বোর্ডের ট্যাক্স বন্ধের মে আন্দোলন হয়, তাতে কিশোরীপতি রায় ও সাতকড়পতি রায়ের বিশেষ সহযোগিতা ছিল। এছাড়াও জাড়ার জমিদার পরিবারের মৃগাঙ্কনাথ রায়, কৃষ্ণকিশোর রায়, মুরারীপ্রসাদ রায় , বিজয়চাঁদ রায় ভারতের স্বাধীনতাযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্ৰহণ করেন।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস কংগ্রেস কেন্দ্রিক হওয়ার কারণে ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে উমেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে মুম্বাই - এ জাতীয় কংগ্রেসের যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাতে মেদিনীপুর জেলার বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে কেঁচকাপুরের জমিদার পরিবারের সদস্য বিহারীলাল সিংহ ও নাগেশ্বর সিংহের সাথে পূর্বেই উল্লিখিত জাড়ার জমিদার পরিবারের সদস্য যোগেন্দ্রচন্দ্র রায় যোগ দিয়েছিলেন। ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ও স্বদেশী আন্দোলনের সময় নাড়াজোলের নরেন্দ্রলাল খান, কেঁচকাপুরের নাগেশ্বর সিংহ এবং তৎকালীন চন্দ্রকোনা পৌরসভার পৌরপিতা ভরত রামানুজ দাস মহন্ত মহারাজের নেতৃত্বে এই অঞ্চলের আন্দোলনকে গণমুখী করেছিল। ১৯২০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে গান্ধীজির নেতৃত্বে যে অহিংস আন্দোলন শুরু হয়েছিল তাতে অগ্ৰণী ভূমিকা গ্ৰহণ করেছিলেন কেঁচকাপুরের জমিদার পরিবারের সদস্য আশুতোষ সিংহ, নাগেশ্বর সিংহ, বিহারীলাল সিংহ। সহযোগী ছিলেন জানকিপদ দত্ত, কিশোরীপতি রায়, রাজেন্দ্রলাল আদিকারী, হরিপদ দাঁ, মোক্ষদাচরণ সামধ্যায়ী, মোহিনীমোহন দাস, যতীশচন্দ্র ঘোষ, সুরেন্দ্রনাথ অধিকারী, মনোতোষ রায়, স্বদেশ রঞ্জন দাস, হরিসাধন পাইন প্রমুখ হিতৈষীগণ।
১৯৩০ খ্রীষ্টাব্দে ডাঃ যতীশ ঘোষ, মোহিনী মোহন দাস, মনোতোষ রায়, মৃগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে লবণ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দাসপুরের চেঁচুয়ার হাটে যে দারোগা হত্যা সংগঠিত হয়েছিল তারই পরিপ্রেক্ষিতে চন্দ্রকোনা অঞ্চলের কেঁচকাপুরের আশুতোষ সিংহ, ডাঃ গৌরহরি ঘোষ, রামমোহন সিংহ, এবং শালঝাটির রামচন্দ্র সরকার ও লক্ষণ সরকার আন্দোলনকারীদের সহযোগিতা করেছিলেন। ১৯৩৭ খ্রীষ্টাব্দে কংগ্রেসের উপর থেকে বে-আইনী আদেশ ব্রিটিশ সরকার প্রত্যাহার করে নিলে ১৯৩৮ খ্রীষ্টাব্দের ৩রা মে ডাঃ যতীশচন্দ্র ঘোষের আন্তরিক আহ্বানে ও তত্ত্বাবধানে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের তৎকালীন সভাপতি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর কোলকাতা -মেদিনীপুর - চন্দ্রোকোনারোড হয়ে ঘাটাল যাওয়ার পথে সাতকড়িপতি রায়, দেবেন্দ্রলাল খান, আশুতোষ সিংহ, অরবিন্দ মাইতি ও জহরলাল বক্সির সাহচর্যে চন্দ্রকোনার কালিকাপুরে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু যে সভা করেন তার পৃষ্ঠপোষকতা করেন কেঁচকাপুরের জমিদার। কালিকাপুরের সভায় চন্দ্রকোনার বনবিহারী দাঁ, রামজীবনপুরের গৌরমোহন সেন ও আমদানের সত্যগোপাল মুখোপাধ্যায় সুভাষচন্দ্রের হাতে মানপত্র তুলে দেন। ১৯৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় ঘাটাল, দাসপুর, চন্দ্রকোনা, ক্ষীরপাই, রামজীবনপুর, জাড়া, কেঁচকাপুর, নাড়াজোলের রাজনীতি সচেতন মানুষ স্ব স্ব গ্ৰাম বা শহর পরিক্রমা করে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে দিতে বন্দেমাতরম ধ্বনিতে মুখরিত করে তোলে।
স্বাধীনতার ইতিহাসে ঘাটাল মহকুমার জমিদার পরিবারের ভূমিকার পাশাপাশি ঘাটাল মহকুমার অন্তর্গত ছোট বড় সামন্তদেরও ভূমিক উপেক্ষিত নয়। যেমন দাসপুর থানার রাধাকান্তপুরের মোহিনীমোহন দাস ও তার পুত্র স্বদেশরঞ্জন দাস, ঘাটালের ডাঃ যতীশচন্দ্র ঘোষ, খড়ারের হাইত পরিবার, ইড়পালার পাল বংশের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য দাবি রাখে। এই সব সামন্ত শ্রেণীর পরিবার দেশের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাহায্য করে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করতে সহায়তা করেছে ।
এইভাবে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে বেগবান করতে দেশের নানা প্রান্তের জমিদার ও সামন্ত শ্রেণীর ভূমিকা ইতিহাসের উজ্জ্বল অধ্যায়। স্বাধীনতার ইতিহাস জমিদার ও সামন্তদের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া রচিত হতে কিনা তা লাখ লাখ যুক্তি তর্কের খাতিরে ঐতিহাসিকরা বিচার করবেন। তেমনি ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে ঘাটাল মহকুমার জমিদার ও সামন্তদের ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে আছে।
গ্ৰন্থ ঋণ :
১) মেদিনীপুর : ইতিহাস ও সংস্কৃতির বিবর্তন - সম্পাদনা - ডঃ প্রণব রায় ।
২) পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি - বিষয় ঘোষ
৩) ঘাটাল বর্ষপঞ্জী ১৯৯০ - ৯১
৪) স্বাধীনতা সংগ্রামে মেদিনীপুর - বসন্ত কুমার দাস
৫) নাড়াজোল : এক অনন্য জনপদ - দেবাশিস ভট্টাচার্য
৬) জাড়া গোলক বৃন্দাবন - রোহিনীনাথ মঙ্গল
৭) চন্দ্রকোনা : ইতিহাস ও সংস্কৃতি - ডাঃ সুদর্শন রায়