বণিকের 'মানদণ্ড', 'রাজদণ্ডে' রূপান্তরিত হওয়ার পর থেকেই ইংরেজ শাসকের অনৈতিক শাসন, অত্যাচার, নিপীড়নের বিরুদ্ধে দিকে দিকে বাঙালি তথা ভারতবাসী গর্জে উঠেছিল। কখনো নিয়মতান্ত্রিক পথে, কখনো সশস্ত্র সংগ্রামের পথ অবলম্বন করে বুঝিয়ে দিয়েছিল এ মাটি খুব শক্ত মাটি, স্বাধীন মাটি। এখানে তাদের শাসন শোষণ খুব বেশি দিনের নয়। তবুও তাদের শোষণ ভারতবাসীকে প্রায় দীর্ঘ দু'শ বছর সহ্য করতে হয়েছিল। অবশেষে অনেক সংগ্রাম, আত্মত্যাগ, আত্মবলিদানের পর ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট ভারত ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তি লাভ করে। এই দিনটির জন্যই এত বছর ধরে বাংলা সহ ভারতের নানান স্থানে এত সংগ্রাম, আত্মবলিদান। আজকের এই প্রবন্ধে আমরা বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল মহকুমার চন্দ্রকোণা থানার স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করব। সময় সীমা ১৯০৫ খ্রী : বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ও স্বদেশী আন্দোলন থেকে ১৯৪২ খ্রী : আগস্ট আন্দোলন পর্যন্ত।
ভারতে ব্রিটিশ শাসনের এক কলঙ্কজনক ঘটনা হল ১৯০৫ খ্রী : বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত গ্রহণ। ইংরেজ সরকারের এই জঘন্য ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষ আন্দোলনে নামেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের পুণ্যভূমি, বিপ্লবের মাটি অখণ্ড মেদিনীপুরের নানান স্থানেও শুরু হয়েছিল বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন। এই আন্দোলনের দুটি দিক ছিল, এক- বিদেশী দ্রব্য বর্জন ও দুই -স্বদেশী দ্রব্য ব্যবহার। ঘাটাল সহ চন্দ্রকোণার বিভিন্ন অঞ্চলে এই আন্দোলনের ঢেউ অনেকটাই পড়েছিল। কেঁচকাপুরের জমিদার নাগেশ্বর সিংহ ও তৎকালীন চন্দ্রকোণা পৌরসভার চেয়ারম্যান ভরত রামানুজ দাস মহন্ত মহারাজের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনকে এই অঞ্চলে যথেষ্ট গণমুখী করেছিল। তাদের উদ্যোগে ও আমন্ত্রণে রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ঘাটালে এসেছিলেন। বিদেশী পণ্য বর্জনের জন্য তখন বিভিন্ন স্থানে সভাসমিতির অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল।
১৯২০ সালে মাহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে সারা ভারত জুড়ে যে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল তার ঢেউ এসে পড়ে ঘাটাল মহকুমার অন্যান্য স্থানের ন্যায় চন্দ্রকোণা থানাতেও। চন্দ্রকোণা থানার বিভিন্ন অঞ্চলের সক্রিয় কংগ্রেসী নেতৃবৃন্দ যথা জাড়ার কিশোরীপতি রায়, সাতকড়িপতি রায়, কেঁচকাপুরের আশুতোষ সিংহ, চন্দ্রকোণা শহরের রাজেন্দ্রলাল আদিকারী, হরিপদ দাঁ, জানকিপদ দত্ত প্ৰমুখ দেশ সেবকগণ ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে এই আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রবর্তিত আইন আমান্য আন্দোলনের প্রভাবও চন্দ্রকোণা তথা ঘাটাল মহকুমাতে ব্যাপক ভাবে পড়েছিল। চন্দ্রকোণাতে এই আন্দোলন প্রবর্তন ও পরিচালনার জন্য চন্দ্রকোণার যে সব কংগ্রেস কর্মী অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তারা হলেন ভরত রামানুজ দাস মোহন্ত, রাধারমণ সিংহ, রাধানাথ সিংহ, ধুর্জটি কুমার চক্রবর্তী, শম্ভুনাথ পাঁজা, রাতিকান্ত মণ্ডল, শেখ আমির আলি, বিনোদ বিহারী ঘোষ, লক্ষ্মণ চন্দ্র অধিকারী, বনবিহারী সিংহ, সুধীরচন্দ্র মহাদন্ড, নিরঞ্জন দত্ত, ডাঃকালিপদ পাল, শচীনন্দন মুখোপাধ্যায়, হরিপদ মণ্ডল, সতীশ চন্দ্র বর, সতীশ বাপলি, গৌরহরি ঘোষ, রামমনোহর সিংহ, সুরেন্দ্র মণ্ডল, লক্ষ্মণ সরকার প্ৰমুখ। চন্দ্রকোণা থানার বিপ্লবীদের আঁতুড়ঘর কেঁচকাপুরের সিংহ রাজবাড়ীর বিহারীলাল সিংহ, নাগেশ্বর সিংহ, আশুতোষ সিংহ এবং জাড়ার কিশোরীপতি রায়, সাতকড়িপতি রায়ের অবদান অবিস্মরণীয়। সেই সময় এঁদের নেতৃত্বে আন্দোলনকারীদের উৎসাহিত করার জন্য চন্দ্রকোণা থানার বিভিন্ন অঞ্চলে সভা সমিতির আয়োজন করা হত। গড়বেতার রামসুন্দর সিংহ, ঝাড়গ্রামের শৈলজানন্দ সেন, নাড়াজোলের রাজা দেবেন্দ্রলাল খান, মেদিনীপুরের অতুল চন্দ্র বসু, ঘাটালের যতীশ চন্দ্র ঘোষ, মোহিনীমোহন দাস প্ৰমুখ কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতৃবৃন্দ এই সব সমাবেশে আসতেন।
চন্দ্রকোণা থানার পুলিশ অফিসারদের তখন কঠোর নজরদারি। তাদের নজরদারি ও অত্যাচারকে উপেক্ষা করেই আন্দোলনকারীরা সেসময় ইংরেজদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। সে দিনটা ছিল ১৮মে, ১৯৩০ খ্রী :। আইন অমান্য আন্দোলন প্রবর্তনের জন্য চন্দ্রকোণা ও তার পার্শ্ববর্তী ঘাটাল, দাসপুর থানার ৪০০-এরও বেশি কংগ্রেস কর্মীকে গ্রেফতার করে চন্দ্রকোণা থানাতে আনা হয়। এদের মধ্যে চন্দ্রকোণার রাধারমণ সিংহ, কেঁচকাপুরের ডাঃ গৌরহরি ঘোষ, ধুর্জটি কুমার চক্রবর্তী প্ৰমুখ প্রথম সারির নেতারাও ছিলেন। দিনটি রবিবার ছিল বলে চন্দ্রকোণা থানাতেই কোর্ট বসিয়ে তাঁদের বিচার করা হয়। বিচারে ডাঃ গৌরহরি ঘোষের ১ বছর এবং ধুর্জটি কুমার চক্রবর্তী ও রাধারমণ সিংহের ৬ মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। বাকি গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের উপর অকথ্য অত্যাচার করে তাঁদের চন্দ্রকোণার সীমানা পার করে আঁধারনয়ন জঙ্গলের দিকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। পরে পরে এমন ঘটনা চলতেই থাকে। বিভিন্ন জায়গাতে হানা দিয়ে আন্দোলনকারীদের গ্রেফতার করা হয়। রাধানাথ সিংহ, শম্ভুনাথ পাঁজা ( চন্দ্রকোণা শহর ), হরিপদ মণ্ডল (ভালুককুন্ডু ), রতিকান্ত মণ্ডল, বিভূতি ঘোষ (ক্ষীরপাই ), জলধর চট্টোপাধ্যায়, প্রহ্লাদ চন্দ্র সেন, গৌরহরি সেন (রামজীবনপুর ), অবিনাশ পাল (আকনা গোপালপুর ) প্রমুখ নেতৃত্ববৃন্দও এই সময় পর্বেই কারাবরণ করেছিলেন।
এই সময় ঘাটাল মহকুমার বিভিন্ন অঞ্চলের ন্যায় চন্দ্রকোণাতেও পুলিশের নিয়মিত রুটমার্চ হত এবং সেই সাথে চলত পুলিশি অত্যাচার। চন্দ্রকোণা থানার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে আন্দোলনকারীদের তখন প্রায়শই ধরপাকড় করে চন্দ্রকোণা থানাতে এনে তাদের উপর অকথ্য অত্যাচার করা হত। শারীরিক উৎপীড়ন এতটাই হত যে অনেকে মারাও যেতেন। অমলেশ্বর সিংহ (কেঁচকাপুর), আশুতোষ পাল (পলাশচাপড়ি ) এমনই দুজন আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন যারা গোরা সৈন্যদের হাতে মারা যান। জানা যায় এই সময় পর্বে (১৯৩২ খ্রী :) অমলেশ্বর সিংহকে ধরে এনে তাঁর উপর শারীরিক অত্যাচার এতটাই করা হয় যে তিনি মারা যান। তাঁর মৃতদেহটিকে গোরা সৈন্যরা চন্দ্রকোণার সীমানার ওপারে গড়বেতার আঁধারনয়ন জঙ্গলে ফেলে দিয়ে আসে। পলাশচাপড়ির আশুতোষ পালও এমনই এক বিপ্লবী ছিলেন যাকে প্রাণ দিতে হয়েছিল ইংরেজ সৈনিকদের হাতে। সে ঘটনাও ১৯৩২ সালের। সস্ত্রীক আশুতোষ পালকে চন্দ্রকোণা থানাতে ধরে আনা হয়। ওনার স্ত্রীর নাম ছিল শশীমুখী দেবী। উনিও ছিলেন একজন সক্রিয় কংগ্রেস কর্মী। ওনাদের চন্দ্রকোণা থানাতে ধরে এনে অত্যাচার করা হয় ও আন্দোলনকারীদের গোপন তথ্য জানার চেষ্টা করা হয়। শত অত্যাচার সত্ত্বেও কিন্তু ওনারা মুখ খুলেননি। শোনা যায় সেদিন মেদিনীপুরের অত্যাচারী জেলাশাসক ডগলাস স্বয়ং চন্দ্রকোণা থানাতে উপস্থিত ছিলেন। ওনার বুটের আঘাতেই ক্ষতবিক্ষত হন আশুতোষ বাবু জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। দুদিন বাদেই ওনার মৃত্যু হয়।
১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে আইন অমান্য আন্দোলন প্রত্যাহারের পর ১৯৩০ ও ১৯৪০ -এর দশকে ভারতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দুটি ধারায় প্রবাহিত হতে থাকে। একটি কংগ্রেসের নেতৃত্বে জাতীয় আন্দোলন, অপরটি কংগ্রেসের মধ্যে বামপন্থীভাবাপন্ন নেতাদের নেতৃত্বে বামপন্থী আন্দোলন। কংগ্রেস নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভের পক্ষপাতী, ছিলেন এবং বামপন্থীরা গণ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে দেশের শ্রমিক, কৃষক ও সাধারণ মানুষের বিভিন্ন দাবিদাওয়া আদায়ের ব্যাপারে সচেষ্ট ছিলেন। বামপন্থীদের প্রভাব খর্ব করার উদ্দেশ্যে ১৯৩৮ সালে হরিপুরায় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনের জন্য গান্ধী বামপন্থী নেতা সুভাষচন্দ্র বসুকে সভাপতি মনোনীত করেন। কিন্তু সুভাষচন্দ্র বসু তাতে অস্বীকৃতি জানান এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে বাংলার বিভিন্ন স্থানে পরিভ্রমণ করেন।
এই উদ্দেশ্যেই তিনি ১৯৩৮ সালে দুই বার এই অঞ্চলে আসেন এবং ঘাটাল মহকুমার নানান স্থানে সভা করে কংগ্রেসী কর্মীদের উদ্দীপিত করে যান। ১ম বার এসেছিলেন ১৯৩৮ সালের ৩০ শে এপ্রিল। চন্দ্রকোণার কালিকাপুরে এক বিরাট জন সমাবেশে তিনি বক্তব্য রাখেন। ঘাটাল সহ চন্দ্রকোণার কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতারা উপস্থিত ছিলেন সেদিন। সেদিন ওই সভাতে রামজীবনপুরের অধিবাসীবৃন্দ ও কংগ্রেসের সেবকবৃন্দের পক্ষ থেকে সুভাষচন্দ্র বসু কে একটি মানপত্র দেওয়া হয়েছিল এবং মানপত্রটির প্রতিলিপি সভায় উপস্থিত সকলের মধ্যে বণ্টনও করা হয়েছিল। চন্দ্রকোণার সতীশ চন্দ্র ঘোষ, বনবিহারী দাঁ, রামজীবনপুরের গৌরমোহন সেন, আমদানের সত্যগোপাল মুখোপাধ্যায় সুভাষচন্দ্রের হাতে ওই মানপত্রটি তুলে দেন। এই অপরাধে রামজীবনপুরের বাবুলাল ইনস্টিটিউশনের ছাত্র সত্যগোপাল মুখোপাধ্যায়কে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
এই অঞ্চলের কংগ্রেসী নেতৃবৃন্দের আহ্বানে সুভাষচন্দ্র বসু আবার পরের মাসেই আসেন। দিনটি ছিল ১৮ই মে। মেদিনীপুর থেকে চন্দ্রকোণা রোড হয়ে তিনি আবার আসেন চন্দ্রকোণার কালিকাপুরে। সঙ্গে ছিলেন নাড়াজোল রাজ দেবেন্দ্রলাল খান, সাতকড়িপতি রায় প্ৰমুখ নেতৃবৃন্দ। চন্দ্রকোণা শহরের মুন্ডুমালাতে তাঁর হুডখোলা গাড়ি দাঁড় করিয়ে তাঁকে মালা দেন কিশোর সত্য ঘোষাল (পারবর্তী সময়ের প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা ) সহ অনেকেই। চন্দ্রকোণা শহর হয়ে সুভাষ চন্দ্র বসু এসে পৌঁছালেন কালিকাপুরে। সে দিনের সমাবেশেও হাজার হাজার লোক। যদিও আবহাওয়া সেদিন মোটেই অনুকূল ছিল না। সকাল থেকে অবিরাম ধারায় ঝড় জল হয়েছিল। কংগ্রেস কমিটির সভাপতি সুভাষচন্দ্র বসু কে আবার দেখার জন্য এবং তাঁর বক্তব্য শোনার জন্য বৈশাখী ঝড় বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ, কংগ্রেসী কর্মী জমায়েত হয়েছিলেন কালিকাপুরের ময়দানে। সেদিনের শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, কংগ্রেসী কর্মীদের উপেক্ষা করতে হয়েছিল অত্যাচারী পুলিশবাহিনীকেও। কেননা চন্দ্রকোণার পথে পথে তখন চলত পুলিশি টহল। যাইহোক সেদিন সেসব বাধাকে অতিক্রম করে কিশোর থেকে বৃদ্ধ সকলেই হাজির হয়েছিলেন এই সমাবেশে। বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা কেঁচকাপুরের জমিদার রামমনোহর সিংহ (চন্দ্রকোণা থানার তৎকালীন কংগ্রেস কমিটির সভাপতি) সহ চন্দ্রকোণার প্রথম সারির কংগ্রেসী নেতৃবৃন্দ সেদিন সম্বর্ধনা জানিয়েছিলেন সুভাষ চন্দ্র বসুকে। কালিকাপুর থেকে সুভাষচন্দ্রের গাড়ি এগিয়ে গিয়েছিলো ঘাটালের দিকে।
১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হলে এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে তেমন উদ্দীপনা বা সক্রিয়তা দেখা যায়নি, যেমনটা দেখা গিয়েছিলো তমলুক বা কাঁথি মহকুমাতে। এর কারণ হিসাবে বলা যায়, এই সময় কংগ্রেসের সমস্ত স্তরের কমিটিকে ব্রিটিশ সরকার বেআইনী ঘোষণা করেছিল। তাছাড়া জেলা ও মহকুমা স্তরের নেতাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন কারারুদ্ধ, কেউ ছিলেন গৃহে অন্তরীণ আবার কেউ বা জেলাস্তরে নির্বাচিত। যানবাহনের ওপরও ছিল জোরদার নিয়ন্ত্রণ। প্রশাসন বিভাগও বিপ্লবীদের ব্যাপারে অতি সতর্ক কঠোর। পথে পথে তখন পুলিশের টহলদারি। এই অবস্থায় দেশ সেবকদের পক্ষে সঙ্ঘবদ্ধতা তো দূরের কথা পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষা করাই ছিল দুরূহ। তাছাড়া এই অঞ্চলের অনেক নেতাই সুভাষের ফরওয়ার্ড ব্লক, শ্যামাপ্রসাদের হিন্দু মহাসভা, জিন্নার মুসলিম লীগ ও কমিউনিস্ট দলের প্রভাবে প্রভাবান্বিত ছিল। বলাই বাহুল্য হিন্দু মহাসভা, মুসলিম লীগ এই আন্দোলন সম্পর্কে নিরপেক্ষ এবং কমিউনিস্টরা
বিরোধী ছিল। তা সত্ত্বেও ১৯৪২ সালের ৯ই / ১০ই আগস্ট চন্দ্রকোণা থানার শহর চন্দ্রকোণা, কেঁচকাপুর, ক্ষীরপাই, রামজীবনপুর, জাড়া প্রভৃতি রাজনীতি সচেতন গ্রাম ও শহরে 'করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে', 'বন্দেমাতরম্', 'ইংরাজ ভারত ছাড়ো' ইত্যাদি শ্লোগান দিতে দিতে মিছিলগুলি স্ব স্ব শহর ও গ্রাম পরিক্রমা করে ও প্রতিবাদ সভায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। কেঁচকাপুরে রামমনোহর সিং, ক্ষীরপাই এ বিভূতি ঘোষ, রামজীবনপুরের জলধর চট্টোপাধ্যায়, চন্দ্রকোণায় শচী মুখোপাধ্যায় ও লক্ষ্মণ অধিকারী এবং জাড়ায় কৃষ্ণপ্রসাদ রায়, অবনীপ্রসাদ রায়, বিজয় চাঁদ রায় ও বিশ্বনাথ চৌধুরী প্ৰমুখরা এসব মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন। এই সময় কেশপুরের রবি মিত্র ও হরেণ মিত্রের অধিনায়কত্তে চন্দ্রকোণার মল্লেশ্বরপুরের মহাজন সারদা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ীতে বন্দুক ছিনতাই ও টাকা গয়না লুঠ হয়। এই ডাকাতি মামলায় অন্যান্যদের সঙ্গে অন্যায়ভাবে নিরপরাধ আশুতোষ সিংহ, বিজয় সিংহ ও ডাঃ গৌরহরি ঘোষ (কেঁচকাপুর), সুরেন্দ্রনাথ মন্ডল (বাঁকা) প্রমুখ ব্যক্তিদের হাজতবাস হয়েছিল। আগস্ট আন্দোলনই ছিল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের শেষ পর্যায়।
বহু সংগ্রাম, আত্মত্যাগের পর অবশেষে এল কাঙ্খিত সেই দিনটি। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট ভারত স্বাধীনতা অর্জন করল। সেই দিনটিতে প্রতিটি দেশবাসীর মনে যে আনন্দ উদ্দীপনার সঞ্চার হয়েছিল তা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। ঘাটাল মহকুমার প্রতিটি শহর গ্রামে সগর্বে ধ্বনিত হয়েছিল বন্দেমাতরম ধ্বনি, উত্তোলিত হয়েছিল তেরঙ্গা পতাকা। চন্দ্রকোণা শহর, ক্ষীরপাই, কেঁচকাপুর জাড়া, রামজীবনপুর, পলাশচাপড়ি প্রভৃতি স্থানেও প্রভাতফেরী করে জাতীয় পতাকা তোলা হয়েছিল। এভাবেই দীর্ঘ লড়াইয়ের পর একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগের অবসান হয়ে নতুন সূর্যের দিন সূচিত হয়েছিল।
তথ্যসূত্র-
১) 'চন্দ্রকোণা: ইতিহাস ও সংস্কৃতি' - ডাঃ সুদর্শণ রায় (১৪২৩ )
২) 'চন্দ্রকোণা চর্চা : অতীত ও বর্তমান' - রোহিণীনাথ মঙ্গল ( শারদীয়া সত্যপথে যাতিক, ১৪১৭)
৩)'মেদিনীপুর :১৯৩৮' - জীবানন্দ ঘোষ ( ঘাটাল একাডেমি, শারদ সংকলন,১৪২৮)
সাক্ষাৎকার-
১)তারাশঙ্কর ভট্টাচার্য্য(গড়বেতা) - ০৪.১১.২০১৮
২)রোহিণীনাথ মঙ্গল (জাড়া)-১২.০৪.২০১৯
৩)রঘুপতি বাপলি(চন্দ্রকোণা) -২২.০১.২০২২