আমাদের কিশোরবেলায় প্রেম তো দূরস্থান। শব্দটি বড়দের কাছে উচ্চারণ করাও ধৃষ্টতার সামিল ছিল। অন্যান্য মায়েরা তাদের সন্তানকে গোপাল, নাড়ুগোপাল, সোনা, মানিক বলে ডাকলেও কী জানি আমার মা আমাকে মুখপোড়া ছাড়া কিছু বলত না। প্রথম দিকে রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারিনি। অনেক পরে বুঝলাম। জানেন, কৈশোরেও আয়না মুখের সামনে রেখে চুল আঁচাড়াতে বেশি সময় নিতে পারতাম না। আর ভগবৎ কৃপায় এখন তো চিরুনি কিনতেই হয় না। যৌবনের প্রাক্কালে মাথায় মরূদ্যান। হতদরিদ্র, বেকার, রোগা, সিড়িঙ্গে চেহারা - এ হেন আমিও প্রেমে পড়েছি! তখন তো আর ফোন ছিল না। দূরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চিঠি একমাত্র উপায়। আমার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় বাড়ির মেয়ে। সে তখন ক্লাস টেনে পড়ে। ঠেলেগুঁজে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ আমি তখন কলেজ। সেকেন্ড ইয়ার বাংলা অনার্স। ১৯৬৯। তখন বোধহয় মেয়েরা ভেবেচিন্তে প্রেমে পড়ত না। না হলে আমার সঙ্গে প্রেম! আমি তার ভালোবাসার পাত্র হয়ে উঠেছি।
আর সত্যি বলতে দ্বিধা নেই, আমিও ভালোবেসে ফেলেছিলাম। মেয়েটির নাম আরশি। আরশিতে আমি নিজেকে আবিষ্কার করি। আমিও যে ভালোবাসতে পারি,কারোর চিঠি আসতে দেরি হলে যন্ত্রণা হয়, অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করতে হয়, চিঠি পড়ে এত আনন্দ পাওয়া যায়, বারবার পড়েও আশা মেটে না এসব আরশিই আমাকে শিখিয়েছে , জানান দিয়েছে। বছরে একবার কি দুবার আরশির সঙ্গে সরাসরি দেখা হত। ওকে দেখে কথা হারিয়ে ফেলতাম আমি। চিঠিতে একটু গুছিয়ে লিখতে পারতাম কিন্তু মনের কথা মুখে উচ্চারণ করতে পারিনি। আরশিও হাসতো। কথা কম বলতো। ওর হাসি আমার হৃদয়ের মধ্যে বিদ্যুতের চমক লাগাতো। জড়িয়ে ধরা , চুম্বন এসবের কোন সুযোগই ছিল না। তবে একবার হাতে হাত রেখেছিলাম। হাত গণনার ছলে ওই হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। মনে হচ্ছিল অনন্ত কাল হাত ধরে থাকি। ওর ঘামে ভেজা হাতের স্পর্শে আমার খসখসে হাতও ঘেমে নেয়ে উঠেছিল। প্রথম প্রেম আর প্রথম চুম্বনের কথা আমৃত্যু কেউ ভুলতে পারে না। আমি পারিনি। আমার ঠিকানায় চিঠি আসতো না। বন্ধুর ঠিকানায় আসতো। বন্ধুর বাড়িতে সবাই বিষয়টি জানতো। আরশির চিঠি যেত ওর দাদার নামে। কেন জানি না ওর দাদা এটা মেনে নিয়েছিল। তখন পনের পয়সা ইনল্যান্ড খাম। তিন পাতা লেখা যায়। কত ছোটছোট করে বেশি বেশি লেখা যায় তার চেষ্টা করতাম। উচ্ছ্বাসে আর ভবিষ্যতের স্বপ্নে ভরা চিঠি। আরশির হাতের লেখা সুন্দর, গোটাগোটা। এই ভরা বাহাত্তুরেও চোখের সামনে ভাসছে। তখন আমি আকাট বেকার। বাড়ির চাল দিয়ে কাক গলে যায়। আরশি তখন ইলেভেন পড়ছে। ওর বাবা এক পাত্র ঠিক করে ফেলেন। ওর দাদা আমার কাছে এসেছিলেন সেই খবর নিয়ে। আরশির চোখের জলই তাকে আমাদের বাড়িতে আসতে বাধ্য করেছিল। সব শুনেও মাথা নত করে দাঁড়ানো ছাড়া আমার কোন উপায় ছিল না। ভীতু আমি সহজেই হার মেনে নিয়েছিলাম। আমার চেয়ে অনেক যোগ্য পাত্রের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। খবর পাই নাতিনাতনি নিয়ে তার সুখের সংসার। আমি অনেক বছর পর সংসার করার মতো রোজগার করতে পেরে বিয়ে করেছি। আমারও সুখের সংসার। মেয়ে জামাই নাতি। বিয়ের অনেক পর পর্যন্ত আমি চিঠি লুকিয়ে রেখেছিলাম কিন্তু শেষে যখন বুঝতে পারলাম আর গোপন করে চিঠিগুলি রাখা যাবে না তখন আমি স্ত্রীর কাছে নিজেকে ধোওয়া তুলসীপাতা প্রমাণ করার জন্য চিঠিগুলোকে জলাঞ্জলি দিয়েছি। কিন্তু আজও আমার হৃদয়ের গোপন কুঠুরিতে রক্ষিত আছে চিঠিগুলি। রক্ষিত আছে ইলেভেন পড়া আরশির মুখ। এখন তার চিঠি পড়ি। কত বাসে, ট্রেনে ঘুরি । তোমাকে খুঁজি। ভাবি গল্প উপন্যাসের মতো তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যাবে আর আমি বলবো, আরশি, বিশ্বাস করো আমার ভালোবাসা মিথ্যে ছিল না। তুমিই আমার ভালোবাসা।