বৃষ্টি হওয়ার বয়সে
সেই যেবার কাঁসাই নদী বান ডাকল আকাশে,
আমি চুপিচুপি উড়িয়ে দিয়েছিলাম, আমার চওড়া ছোটবেলার ছাতাটা।
বড় হব বলে।
মুহুর্তে ট্রেনলাইন বেয়ে ঝমঝম করে ছুটে এসেছে বৃষ্টি।
অবিরাম, মুষলধারা....তারাদের এক ফুঁয়ে নিভিয়ে কত সহস্র জোনাকি জন্ম;
ঘোলা নীল চোখ পৃথিবী বলে মেয়েটা ভিজছিল আমার সাথে।
বৃষ্টি ছাড়া কি ডালপালা গজায়, ফুল ফোটে কবিতাদের?
ভিজতেই থাকি তাই আমরা, ভিজতে ভিজতে হাট, মাঠ, পদ্মবন,
টুপ করে বিশ্বাস-কাগজের নৌকোগুলো ডুবে গেল ওই আকাশের অতল কাঁসাই নদীতে;
স্কুল-কলেজ, বন্ধুরা বিন্দুর মতো দূর।
ঠিক কোন বয়সে মানুষ টের পায় সেও আসলে বৃষ্টি?
হঠাৎ রাস্তা ঝাপসা হয়ে যায়, পৃথিবীর ঘোলা নীল চোখ আরো ঘোলা।
ঝাপসা রাস্তায় বাড়ি ফেরা বড্ড জটিল।
কিন্তু আমার চওড়া ছোটবেলার ছাতাটা যে উড়ে গেছে।
আর, একবার বড় হয়ে গেলে তো আবার ছোটো হওয়া যায় না!
ধানপাতার গন্ধ আসে
ধানপাতার গন্ধ আসে।
পায়ের নীচে বোবা সমুদ্র-হলুদ, ধূ- ধূ মাঠের পর মাঠ।
শেষ রেলগাড়ি যখন পুরোনো বন্ধুর মতো একা করে চলে গেল অবেলায়,
চাঁদ হলদেটে- সবুজ তুমুল জ্যোৎস্না জ্বালিয়েছিল বাড়িজোড়া।
জ্যোৎস্নায় পৃথিবী স্বপ্ন দেখে, মানুষের ঘুমোতে নেই।
তাই নেমে যাই শস্য স্রোতে, নিঃশব্দে।
ইতিউতি কুয়াশার দ্বীপ, চর ছেড়ে গভীর আরো গভীর জীবনের দিকে;
সমস্ত হিম ধানবনে জেগে আছে কালপেঁচাদের ছোট্ট মেয়েটি আমার পাশে,
ওই শাঁখে কাদের যেন দীর্ঘশ্বাস, আমাদের খিদের ভেতরে গাঢ় হয় ভোর।
সাঁতার, বিসুখ, সুখ- অসুখ ঝুম শিশিরে ডুবসাঁতার... কতদূর কে জানে!
অবসাদের রাত পেরিয়ে ভেসে উঠি শেষমেষ।
তারপর হেমন্তের ক্ষেত, প্রান্তর, তেপান্তর থেকে ফিরলেই... বিস্ময়!
ফেলে আসা সব আল, উতরাই- ঢাল কখন যেন সোনা হয়ে গেছে!
স্মৃতি ছুঁলে ধানপাতার গন্ধ
।
হিমঝুরি ফুল ফোটে
হিমঝুরি ফুল ফোটে।
ধুম জ্যোৎস্নায় হাঁটতে হাঁটতে টের পাই, চোখের উপর চোখ রাখল চাঁদ।
চারিদিকে মিহি স্বপ্নের সুগন্ধ।
তারপর আমি চলে গেলে দুধসাদা পাপড়ি কখন বিছিয়ে যায় গাছতলা;
ভোর আসে।
হিমঝুরি ফুল ফুটেছিল।
অঘ্রাণ দূর্বার শিষে, সাতষট্টি বছর আগে,
আমার ঠাকুমার মুক্তোর নাকছাবিখানা হারিয়ে গেল যেদিন,
এই চাঁদ এসে নিষ্পলক, তুলেছে চোখ তাঁর দিকে,
তখনও এমনি নরম সুগন্ধ জ্যোৎস্নায়।
একসময় গাছেদের রাত ঝরে ভোর।
ঠাকুমা এখন হাঁটতে পারেন না।
একদিন দেখব, আমার আর একফোঁটাও মাটি নেই।
হিমঝুরি ফুল ফুটবে।