আহা মনকেমন!
সুস্মেলী দত্ত
– ‘যত্তো সব ন্যাকামি’
কেউ বলবে, ‘কাজ নেই তো’
– ‘আরে বাবা, খৈভাজা আর মনকেমন কি একই হোলো?’
বিস্তর জলঘোলা করার পর শেষবেলা, শেষপাতে সন্দেশ পরার মতো মাথাটায় ৪৪০ ভোল্ট কারেন্টের ভোঁ ভোঁ ঝিঁ ঝিঁ ডাক। বেশ করেছি, যা করেছি। মনকেমন তো মানুষেরই করে, থুড়ি জীব মাত্রেরই স্বভাব বলা যায়। এ আর এমন কি দোষ বাপু, বরং বন্ধুমহলে বেশ সমাদর পাওয়া যায় – ‘ছেলে বা মেয়েটার মধ্যে গভীরতা আছে’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
গভীরে যাও… গহীনে যাও .. আরও ভেতরে … তার মধ্যে যেতে যেতে (পড়ুন হারিয়ে যেতে যেতে) হঠাৎ কি মনে হয় না, যে এই তো বেশ আছি, আর বাইরে বেরোব না। অর্থাৎ বাইরের সবটাই মুখোশ আর আমি ভেতরে যেতে যেতে জীবনের সারমর্মটা ক্রমশ উপলব্ধি করছি।
হ্যাঁ ঠিক এখানেই মনকেমনিয়াদের অকাট্য যুক্তি। আহা কেনই বা বৃষ্টির সোঁদা গন্ধে কিংবা গোধূলি বেলার মায়াবি আলোতে তাদের অবাধ্য দলছুট মনটা হু হু করবে না! আর কেনই বা ভালো কোন ছবি দেখে, কিছু পড়ে, গন্ধ শুঁকে, কিছু স্পর্শ করে হঠাৎই মনে হবে না যে এই গন্ধ, স্পর্শ বা পড়ার অনুভূতিটি হয়তো কোনোদিন, কোনোক্ষণে, নিদেনপক্ষে আমারই পূর্বজন্মের কোনো এক অভিজ্ঞতা। কবিগুরু বোধহয় সেজন্যই লিখেছিলেন, ‘পুরানো সেই দিনের কথা, ভুলবি কি রে হায় ও সেই’…
আমরা মানে সাধারণ মানুষেরা হয়ত কবির মতো, চিত্রকরের মতো, স্থাপত্য শিল্পীর মতো সেভাবে কোনো নির্দিষ্ট জড়কে অবলম্বন করে মনের ভাবটিকে লতানে গাছের মতো নেতিয়ে ওঠায় তৎপর হতে পারি না, কিন্তু যা হতে পারি তা হল মন নামক বস্তুটিকে আহ্লাদে, আদরে একেবারে পোষ্য মেনিটির মতো বিস্তর প্রশ্রয় দেবার দুরন্ত মালিক অথবা গর্বিত মালকিন।
ব্যাস এখানেই মনকেমনিয়াদের দিব্য জিত। তারা উদাসীন আবার একইসঙ্গে ধোপদুরস্ত, সপ্রতিভ মনকেমনওয়ালা।
আমি দুটোই হতে চাই। হ্যাঁ দু–দুটোই। বাস্তব–জ্ঞান–বুদ্ধিহীন মানুষেরা তাই আমার পরম প্রিয়। না, কোনো কথা নয়… এসো আমরা সকলে মনখারাপ–মনকে বুকের মধ্যে লালন করি। মন–পণ্যটিকে বাজারে বিকোই সুলভে। মন–বীজ অঙ্কুরিত হয়ে মন–মহীরূহ রূপে লকলক করে সর্বসমক্ষে জানান দিক যে আমি আছি, তোমার পাশে … মধ্যে।
মনকেমন করাটা আসলে যে বিলাসিতা নয়, অপরিহার্য তা আমি এখন হাড়ে হাড়ে বুঝেছি আর বুঝেছি বলেই গালে হাত দিয়ে যখন তখন কলম আর কাগজে ইচ্ছাকৃতভাবে ডুব দিই কিংবা হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু অবস্থা ও পারিপার্শ্বিককতার পরিপ্রেক্ষিতে আবার ফিরে আসতেই হয় কঠিন আর কঠোর বাস্তবে। এখানেই মনকেমনের ধকধক ট্রাজেডি। কিছুতেই যেন নিজেকে নিজে তিষ্ঠোতে দেয় না সে। উত্তরোত্তর বেড়েও চলে মনের দুরারোগ্য কর্কট রোগ, তারপর তা জাঁকিয়ে বসে শরীরের আনাচে কানাচে।
মনে রাখবেন, নেভারএন্ডিং এই গল্পের শাখা প্রশাখা কিন্তু এখনও বহুদূর বিস্তৃত। আমরা তার নাগাল পাই না। কি জানি কতদূর…
– ‘কতদূর?’
আহা দূরত্ব মাপতে যেওনা, মাপো শূন্যতা। ভয় নেই, এ ব্ল্যাকহোল নয় এ হলো পরিচ্ছন্ন পরিসর, সেখানে রাজা, উজির, ধনী, দরিদ্র, শিক্ষিত, অশিক্ষিতেরা সবাই এক। এক ও অদ্বিতীয়। গালে হাত দিয়ে এখন তাই ভাবতে বসেছি, ‘তারপর’?
তুমি হাসলে, বললে নীরবতাই শ্রেয়, অত প্রশ্ন করতে নেই। বরং মনকেমনকে মাপো, মাপো…
আমিও এখন তাই তোমার কথায় তা মেপেই চলেছি, মেপেই চলেছি। গালে হাত দিয়ে বৃষ্টি আর গোধূলিকে দেখে হিংসে করি, বলি, তোরা বড্ড সুখী ভাই, কেননা তোদের মন নেই তো!