ঘরের ডাক ।। কেশব মেট্যা

keshab heontor mohool

 

‘পিসেমশায়! আমি কি ঐ উঠোনটাতেও যেতে পারব না?'

–এই শব্দবন্ধ আজ  যেন বুকের মাঝে বারংবার ছ্যাঁৎ করে ছুঁয়ে যাচ্ছে । অমলের মতো কতো কোমলমুখের এখন এই একটাই আর্তি। দেওয়াল তোলা বর্গফুটের কারাগারে অসুখভয়ে বদ্ধ শৈশব। নির্ঘুম রাস্তার বুকেও শ্মশানের নিস্তব্ধতা।  নিজের অসুখ-বিসুখ হলেও না হয় ক'দিন ঘরবন্দি থাকা যায়; কিন্তু এ যে পৃথিবীর অসুখ, গভীর অসুখ!

           গনগনে সূর্য যখন মাঝ-আকাশ থেকে পশ্চিমে ঢলে পড়ছে টিফিন-শেষের ঘন্টার মনখারাপ নিয়ে, তখন আমার হাতে  সহজপাঠ উঠে আসে। ‘নাম তার মোতিবিল, বহুদূর জল, / হাঁসগুলি ভেসে ভেসে করে কোলাহল’। চার দেয়ালের মাঝে কচিকচি মুখগুলোর নিজস্ব কিচিরমিচির ছাড়িয়ে 'কোলাহল' শব্দে ভেসে উঠত ক্লাসরুম। যেন মনে হত ওদের চোখের আকাশে ভেসে যাচ্ছে হাঁসের সেইসব চিরকালীন সাঁতার। নিজের ছেলেবেলার কথা আমার তেমন মনে নেই, তখন কীভাবে ডানা মেলত সহজপাঠের চিল কিংবা বক, কে জানে! কিন্তু এই বয়সে যে সহজপাঠ এভাবে স্পর্শ করে দিগন্ত রঙিন করে তুলছে তা ওই যাদুকরের জন্যই।

      ভিড়ের ভয় আমার আজন্মকাল। কোলাহলের ভিতর একলা কাঁপত রুগ্ন কিশোর বয়স। তাই নির্জন-উঠোন, নিরালা-দুপুর, নিস্তব্ধ- বিকেল, নিঃসঙ্গ নদীর কাছেই  যত অভিযোগ আর অনুযোগ। রবিঠাকুর তখন বক্তৃতার, রবিঠাকুর তখন পাঠ্য বইয়ে আর ওই স্কুলের বারান্দার পাথররঙা মুখ। সেভাবে তেমন আমার অন্দরের হয়ে ওঠেননি। একদিন স্কুলের মঞ্চে প্রথম দেখা  'ডাকঘর' । এক বালক বিছানায় শুয়ে। অসুখ। তার বাইরে বেরোনো বারণ। যখন সে বলছে জানলা থেকে দেখা দূরের পাহাড় পেরিয়ে একদিন  চলে যাবে...পৃথিবীটা কথা বলতে পারে না... নীল আকাশ হাত তুলে ডাকে আর দুপুরবেলার একলা জানলার ধারে বসে সেসব ডাক নাকি শোনা যায়! এসব দেখে শুনে আমার মনে হয়েছিল– আমিই অমল। সেই থেকে ডাক শোনার আগ্রহ নিয়ে একলা জানলায় কাটিয়েছি কত দুপুর।

     এই একটা 'ডাকঘর'  কতবার যে কাঁদিয়েছে আমায় তার ইয়ত্তা নেই। যতবার পড়েছি মনে হয়েছে এই শেষবার, নিজে থেকে কে আর মনখারাপের বাঁশি বাজাতে চায়! দিন যায় মাস যায়, মনে হয় কতদিন আয়নায় মুখ রাখা হয়নি। কতদিন দেখা হয়নি আমার অমলের সাথে। ডুমুর গাছের নীচে যে ঝরনা, নাম নেই, তার ধারে বসে অমল একদিন ছাতু খেতে চেয়েছিল। পিসিমা বলেছেন অমল ভালো হয়ে গেলে একদিন নিশ্চয়ই ঐ ঝরনা ধারে নিয়ে গিয়ে ছাতু খাইয়ে নিয়ে আসবে। এই দৃশ্যে আমি আমার বড়পিসিকে কাছে পাই। মনে হয় আমি তার কোলে মাথা রেখে জিজ্ঞেস করছি– কবে আমি ভালো হব? আর আমার আলাভোলা বড়পিসিও অমলের পিসিমার মতোই বলে ওঠে–'আর তো দেরি নেই বাবা!'

পাঁচমুড়া পাহাড় দেখিনি আমি। আকাশের শেষ থেকে পাখির ডাক শুনে মনকেমন করতে শিখেছি অমলের কাছ থেকে।  অমলের  সহজ ইচ্ছেগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে দেখি এক দিকের বাতাস কেমন করে অন্যদিকে বয়ে যায়। অথচ অমলের শরীরে বিষ ছিল এই হাওয়া এই বাতাস এমনকি সূর্যাস্তের আলো। রাজকবিরাজ যেদিন এসে বললেন, খুলে দাও সব জানলা দরজা। অমল দেখতে পেয়েছিল অন্ধকারের ওপারকার তারাদের সংসার, তার আর অসুখ নেই। তখন আমার মনের গভীরে আশার আলো জেগেছিল। এইবার, এইবার নিশ্চয়ই অমল বেরিয়ে পড়বে চিঠি নিয়ে, কিংবা পাঁচমুড়া পাহাড়ের তলায় শ্যামলী নদীর ধারে। সুর করে ডেকে উঠবে দই–দই– ভালো দই! হয়তো বা সুধাকেই প্রশ্ন করবে –ভুলে গেলে আমায়! হয়তো বা প্রহরীর ঘন্টাধ্বনি শুনে কেমন করে উঠবে মন, সেই দূর দেশের কথা ভেবে! কিন্তু তা তো হল না। ঢং ঢং ঘন্টা ধ্বনিতে যেমন ছুটির আনন্দ লেখা থাকে, তেমনি থাকে বিদায়ের সুর।  এমনি করেই একদিন সমস্ত মনকেমন অসহায় হয়ে দাঁড়াল বিচ্ছেদ-যন্ত্রণায়। অমল শুয়ে, ঘরের প্রদীপ নিভে গেল!  রাজা এসে অমলকে ডেকে নিয়ে গেলেন অন্য ঘরে! সেই হিমের ঘরে!

একটা হাহাকার চিরদিনের মতো লিখে রেখে গেলেন যাদুকর। জেগে থাকল একলা দুপুর আর বিষণ্ণ বিকেল। আর ঘরের ভিতর বসে বসে আমৃত্যু মনকেমন করে যাব আমরা, অমলের বন্ধু যারা।

একক কবিতা সন্ধ্যা



মহুল ওয়েব প্রকাশিত বিভিন্ন সংখ্যা



করোনা Diary



আমাদের কথা

আমাদের শরীরে লেপটে আছে আদিগন্ত কবিতা কলঙ্ক । অনেকটা প্রেমের মতো । কাঁপতে কাঁপতে একদিন সে প্রেরণা হয়ে যায়। রহস্যময় আমাদের অক্ষর ঐতিহ্য। নির্মাণেই তার মুক্তি। আত্মার স্বাদ...

কিছুই তো নয় ওহে, মাঝে মাঝে লালমাটি...মাঝে মাঝে নিয়নের আলো স্তম্ভিত করে রাখে আখরের আয়োজনগুলি । এদের যেকোনও নামে ডাকা যেতে পারে । আজ না হয় ডাকলে মহুল...মহুল...

ছাপা আর ওয়েবের মাঝে ক্লিক বসে আছে। আঙুলে ছোঁয়াও তুমি কবিতার ঘ্রাণ...