logo corona

আজ স্বাধীনতা দিবস ।। অ্যাঞ্জেলিকা ভট্টাচার্য
 swadhinota
 
পাশের বাড়ির টিয়াটা সারাদিন ডেকে চলেছে।মিনতি একমনে বারান্দার গ্রিল মুছতে থাকে । টিয়ার ডাকে  একবার করে পাশের বাড়ির পোলুদের বারান্দার দিকে চোখ চলে যায়। খাঁচাটা বেশ বড় , তারমধ্যে আবার দোলনা আছে। চারদিন হল টিয়াটা এই শহরে এসেছে। পোলুর মামাবাড়ি ঝাড়খণ্ডে। ঘুরতে গিয়ে লকডাউনে আটকে গেছিল। ফিরেছে এই চারদিন , খাঁচায় বন্দি টিয়া নিয়ে।
মিনতিকে পলুর মা গল্প করছিল , কীভাবে পলুর দাদু পেয়ারাগাছ থেকে পাখিটাকে ধরেছে। মিনতির কিন্তু শুনে একটুও ভালো লাগেনি। আহারে , নিশ্চয়ই বন্ধুবান্ধব সবার সঙ্গে খেলা করত , আকাশে অনেক দূর  উড়ে যেত। এভাবে
আকাশের পাখিকে খাঁচায় বন্দি করলে সে তো রাতদিন চিৎকার করবেই । মিনতিও বন্দি কিন্তু চিৎকার করে না। সে জানে এই  খাঁচাটা ছাড়া তার আর উপায় নেই অন্য কোথাও যাওয়ার।
মিনতি যখন নয় বছরের , মিনতির মা এসে এই রায় বাড়িতে তাকে দিয়ে গেল। মিনতির কানে কানে বলে গেল  “দুবেলা ভালো খাওয়া পরা পাবি , মনখারাপ করলে বাড়িতে ঘুরে আসবি”। প্রথম প্রথম মিনতির খুব মনখারাপ করত , কান্না পেতো।  বাড়িতে খবর দিতো রায় জেঠিমা মিনতির মা এসে বার কয়েক নিয়েও গেছিল।
বাড়িতে ভাইবোনদের সঙ্গে খেলা করতে খুব ভালো লাগতো  মিনতির। নদীতে সাঁতার
কাটত , ভাইয়ের সঙ্গে ঘুড়ি ওড়াত । ফেরার সময় খুব কাঁদত। ফিরে এসেও দুদিন
গুম হয়ে বসে থাকত। একদিন রায় জেঠিমা  মিনতির মা কে বলল  “ তুমি মিনতিকে
নিয়ে যাও , এমন মন মরা দেখলে পাড়ার লোকে কী বলবে ? আমরা কি জোর করে আটকে
রেখেছি নাকি ! তারপর দুদিন পরে দেখবো টিভিতে  খবর হয়ে গেছে , ভালো করতে
গিয়ে আমরাই অপরাধী হয়ে গেছি। শিশু শ্রমিক নিয়ে লম্বা লেকচার দিচ্ছে ”।
কথাটা খুব ভুল বলেনি রায় গিন্নি। এমন অনেক মিনতি না খেতে পেয়ে ঘুরে বেড়ায়। সবার কপালে কি দুবেলা ভাত , কাপড় জোটে ! মিনতির মা পা চেপে ধরে। “ কী
বলছ গো দিদি , তোমরা মিনতিকে না রাখলে কোথায় যেতাম ! এখনও ঘরে দুটো ছেলে
মেয়ে। তোমাদের পাঠানো টাকায় আমার সংসার চলছে। মিনতির বাপ এমন অসময়ে চলে যাবে কে ভেবেছিল ? তোমরা হলে ভগবান। মিনতি তোমাদের কত নাম করে। ছোট মেয়ে তো তাই একটু অবুঝ ।
তারপর থেকে আর কোনোদিন বাড়ি নিয়ে যায়নি মিনতির মা। মিনতির মন খারাপ করলে
মায়ের বড় বড় জলে ভরা চোখ দুটোর কথা মনে পড়তো  “মিনতি তুই তোর ভাই , বোন ,
আমাকে একটুও ভালবাসিস না”। মিনতি নিজের চোখের জল মুছে মনে মনে বলে – খুব
ভালোবাসি। তোমরা ভালো থাকো সবাই। ভাই বোন পড়াশুনো শিখে অনেক বড় মানুষ
হোক । এসব ভাবতে ভাবতে মিনতি এই বাড়িতেই চারবছর কাটিয়ে দিলো। এখন সে ছোট নয় , বড়। আগে শুধু গোটা বাড়ির বাসন মাজত , জামাকাপড় কাচত , ঘর মুছত। এখন
ছোট দাদাবাবুর খোকাও  সামলায় । সারাদিনে তার ফুরসৎ নেই ।
শুধু এই দুপুর বেলায় বারান্দার গ্রিল মুছতে এসে তার মন ভার হয়ে যায়। স্কুলের ছেলে মেয়েদের দেখে তার মনে পড়ে, সেও এককালে স্কুলে যেতো। স্কুলের বারান্দায় বন্ধুদের সঙ্গে খিচুড়ি খেত। স্বাধীনতা দিবসে স্কুল বাড়ির ছাদে
পতাকা উড়ত। শেষবার ক্লাসের  সবাই মিলে গান গেয়েছিল। প্রথম লাইনগুলো মনে
পড়ছে না । দুটো লাইন মনে আছে “তোমাতে আমরা লভিয়া জন্ম / ধন্য হয়েছি ধন্য
গো”। গানটা দিদিমনি শিখিয়ে দিয়েছিল। হেড স্যার খুব খুশি হয়ে  মিনতিকে দুটো লাড্ডু  দিয়েছিল। এসব কথা মিনতি কবেই ভুলে গেছে। কেন যে বার বার মনে পড়ে !
 গত  চারদিনে মিনতির মতোই এক সঙ্গী জুটেছে,  পোলুদের খাঁচার টিয়া। টিয়া
সারাক্ষণ ডাকে আর মিনতির আওয়াজ পেলেই করুণ ভাবে তাকিয়ে থাকে। পাশাপাশি বাড়ি দুটোর দূরত্ব বেশি নয় । মিনতি শিস দিলেই টিয়াও ডেকে ওঠে ।
বড়দা বাবুর ছেলে টুবান প্রায় মিনতির বয়েসি। সে স্কুলের ফার্স্ট বয় । গান, নাচ, কবিতা, আঁকা, সাঁতার, গীটার, পিয়ানো বাজানো কোন কিছুই বাকি নেই।  তার সারা ঘরে শুধু মেডেল। সামনেই পনেরোই আগস্ট , তার জন্য গান প্রাকটিস করছে। মিনতি  চুপ করে দাঁড়িয়ে শুনছে   “কিরীটধারিণী তুষারশৃঙ্গে / সবুজে সাজানো তোমার দেশ”। গানটা শুনে মিনতির চোখ মুখ
উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। গানের মধ্যেখানেই প্রশ্ন করল – টুবান তুষারশৃঙ্গের মানে কী জানিস  ?
টুবান বিরক্ত হয়ে বলে – বরফে ঢাকা পাহাড় চূড়া। তুই দেখেছিস  কখনও ? যেবার নেপাল ঘুরতে গেলাম সেবার হেলিকপ্টারের জানলা দিয়ে দেখেছি। বড় হলে এভারেস্ট জয় করবো ।
মিনতির সত্যি কোন পাহাড় দেখা হয়নি। মিনতি হি হি করে হেসে বলে –  আমাদের
গ্রামে উইয়ের ঢিবি দেখেছি। টুবান তুই  কিন্তু ঠিক এভারেস্ট জয় করবি। আমরা তোকে টিভিতে দেখবো ।
মিনতির ডাক পড়েছে। তার অনেক কাজ জমে আছে। আজ রান্নার মাসি কাজে আসেনি। তাই তাকেই একটু কেটে বেটে দিতে হবে।
আজ পনেরোই আগস্ট। মিনতি জানে আজ  স্বাধীনতা দিবস। এই দিনে প্রতিবার সবাই টুবানের স্কুলের প্রোগ্রাম দেখতে  যায়। সামনের স্কুলেও  অনুষ্ঠান হচ্ছে। মাইকে গানের আওয়াজ আসছে “আমি ভয় করব না ভয় করব না” ।
পাশের পোলুদের বাড়িতেও তালা। একমাত্র পাখিটা একটানা ডেকে যাচ্ছে। মিনতি
শিস দিতেই ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। খাঁচার দরজার ছিটকিনিটা আজ আলগা
মনে হল। দরজাটা খুলে দিলে কেমন হয় ? কেউ জানতে পারবে না।
মিনতি একটা তারের আঁকশি নিয়ে এসে খাঁচার দরজাটা একটু ফাঁক করে দিতেই, টিয়া উড়ে গিয়ে প্রথমে বসল বারন্দার দেওয়ালে। তার বুঝি বিশ্বাস হচ্ছে না সে মুক্ত। মিনতির দিকে একবার তাকিয়েই উড়ে গেল চোখের আড়ালে। মিনতির কী যে আনন্দ হচ্ছে। জলে ঝাপসা চোখে আর  কিছু দেখতে পাচ্ছে না। হাত তালি দিয়ে লাফিয়ে উঠল “আজ স্বাধীনতা দিবস”।
 
 
 

একক কবিতা সন্ধ্যা



মহুল ওয়েব প্রকাশিত বিভিন্ন সংখ্যা



করোনা Diary



আমাদের কথা

আমাদের শরীরে লেপটে আছে আদিগন্ত কবিতা কলঙ্ক । অনেকটা প্রেমের মতো । কাঁপতে কাঁপতে একদিন সে প্রেরণা হয়ে যায়। রহস্যময় আমাদের অক্ষর ঐতিহ্য। নির্মাণেই তার মুক্তি। আত্মার স্বাদ...

কিছুই তো নয় ওহে, মাঝে মাঝে লালমাটি...মাঝে মাঝে নিয়নের আলো স্তম্ভিত করে রাখে আখরের আয়োজনগুলি । এদের যেকোনও নামে ডাকা যেতে পারে । আজ না হয় ডাকলে মহুল...মহুল...

ছাপা আর ওয়েবের মাঝে ক্লিক বসে আছে। আঙুলে ছোঁয়াও তুমি কবিতার ঘ্রাণ...