logo corona

শোধ ।। ওবায়দুল বারী
 swadhinota
নূরীর মন টা আজ বেশ কিছুদিন ধরেই অজানা আশঙ্কায় ভর করে আছে। কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারছে না। সেয়ানা মেয়ে ঘরে রাখা ঠিক হবেনা ভেবে, সেই যে বাবা বিয়ে দিয়ে দিল... সেজন্যে তো মন খারাপ হয়েই ছিল। শুধু শফিকের একটা দেড় রুমের পাকা বাড়ী আছে, এটাই কি মেয়ের উপযুক্ত পাত্র হওয়ার যোগ্যতা হলো? ছেলে কি আয় রোজগার করে তা দেখতে হবে না? মা' কিছু বলতে আসলেই বলতো...'শোনো... নূরীর মা, সেয়ানা মেয়ে ঘরে রাখা ঠিক না। গঞ্জে মেলেটারী আইছে, হ্যারা নাকি মাইয়াদের ধইরা লইয়া যায়। এখন বিয়া দিলে, জামাই ই দেইখা রাখবো। আমগো আর চিন্তা করন লাগবো না।’ এই করেই বিশেই নূরীর বিয়েটা হয়ে গেল। ঠিক একাত্তরেই এপ্রিলেই
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।
নূরীর বিয়ে নিয়ে নিজের কোনো অলীক স্বপ্ন ছিল না। ক্লাস সিক্স পাশ করার পর বাবা আর পড়ায় নি। তাই তার মধ্যে আকাশ কুসুম কোন স্বপ্নও তেমন কিছু ছিলনা।
বিয়ের ক'দিনের মধ্যেই নূরী কিছু কিছু বুঝতে শিখলো, যে শফিক কিছুই করে না, ভাদাইম্যা টাইপের। সারাদিন কিছু কাজ করে না। দুপুরে একবেলা পেট পুরে খাবার জোটে, তো রাতে আধপেটা। দুটোর বেশী শাড়ি নূরী কখনো দ্যাখে নি। ভাগ্যিস, বাড়ীর চারপাশে কিছু গাছ গাছালি শাকসবজি লাগিয়ে ছিল। তাই বেচাকেনা করে, রান্না বান্না করে দিন যাচ্ছিল। তবে শফিকের মধ্যে তার বৌ কে ভালোবাসার কমতি ছিলনা। একটা ভয় তার মধ্যে ছিল যে, তার ফর্সা সুন্দরী বৌ যেন অন্য কারো চোখে না পড়ে যায়। দিনের মধ্যে দু তিনবার এসে বৌকে জড়িয়ে না ধরলে শান্তি পেত না। বাপের সংসারেও এমন অভাব ছিল বলে, এই অসচ্ছলতা বিয়ের তিন চার মাসের মধ্যেই নূরী গা সওয়া হয়ে গেল।
নূরীর অস্বস্তির শুরুটা প্রায় হঠাৎ করেই। যে খানে সংসারে অভাব অনটন লেগেই থাকে, সেখানে কোথা থেকে এক সুখ পাখী উড়ে এসে বসলো, নূরী ধন্দে পড়ে গেল। চাল ডাল তেল মুরগী আসছে, খানা পিনা বেড়ে গেছে। মাঝে কোথা থেকে একদিন একটা ছাগল এলো, বাঁধা থাকলো খুঁটির সঙ্গে। বেশ মোটাসোটা , তেল চকচকে শরীর। দুদিন বাঁধা থাকলো, আবার একদিন চলেও গেল। বিকেলে কেজি দুয়েক মাংস দিয়ে গেল শফিক। বললো...‘ভালো করে রাধিস বৌ...রাতে মজা করে খাবো।’  নূরী দু' কেজি মাংস একসঙ্গে জীবনেও দেখেনি। রাঁধে বটে, কিন্ত মন টা খচ খচ করে। এতো সব আসছে কোত্থেকে ? কি এমন আয় বেড়ে গেলো শফিকের? কিন্তু, কোনো উত্তর খুঁজে পায় না।
এদিকে গঞ্জের মিলিটারি দের সঙ্গে নদীর দিকে নাকি মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের যুদ্ধ হয়েছে। দুপক্ষেই নাকি বেশ কিছু মারা পড়েছে। রাতে মাঝে মধ্যে দূর থেকে গুলীর শব্দ ভেসে আসে কানে। স্বামীর কোলের মধ্যে ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকে নূরী।
একদিন সাহস করে জিজ্ঞেসই করে ফেললো শফিক কে...‘আচ্ছা... তুমি এসব কোথাও পাও? আগে তো এত সব দেখি নাই। আমার জন্য শাড়ী পাইলা কই...এত খাওন দাওনই বা আসে কোত্থেই কা...?’
শফিক গাল চুলকিয়ে, আমতা আমতা করে বলে...‘আরে গিরামের শান্তি ঠিক রাখোন লাগবোনা? ছাওয়াল পাওয়াল মুক্তি গো'র দলে যাইতেছে, সে গুলান ঠেকান লাগবো না? মুরুব্বিরা আছেনা ? তারাই এই সব দেয়। বেতন তো আর দেয় না, জিনিষপত্র দিয়া বেতন দেয়। তুমি এইসব নিয়া মাথা ঘামাইওনা, কাউরে কিছু বলবাও না। চুপ থাকো। দেহ না, আমি রাতে গিরাম পাহারা দিবার লাগি মাঝ রাইতে বাইত থন বাইর হই...!’
নূরী চুপ করে শোনে। মাঝে মাঝে কানে আসে, তার স্বামী শান্তি কমিটির মেম্বার হইছে। গেরামে এখন অনেক ইজ্জত শফিকের। সঙ্গে আরো খারাপ কথাও কানে আসে। ইসা মণ্ডলের সুন্দরী মেয়েটারে নাকি একদিন গঞ্জে নেবার জন্য মণ্ডলরে বহু টাকা দিয়ে সেধেছে। কিছু মুরুব্বী টাইপের কিছু লোকের বাধার জন্য পারে নি। নূরী ভেবে পায়না, গ্রামের শান্তি রক্ষার জন্য, মেয়েদের গঞ্জের মিলিটারীদের কাছে যেতে হবে কেন? মিলিটারীরা নাকি মেয়ে পেলে খুশী হয়। নূরী হাজার হলেও নারী, আস্তে আস্তে সবই বুঝতে পারে।
একদিন শফিক কে সাহস করে জিজ্ঞাসাই করে বসলো...‘তুমিতো কুনোদিন কুনো মাইয়ার দিক চক্ষু তুলেও তাকাও নি...কিন্তু এসব কি হুনতাছি,...তুমি নাকি গঞ্জে মেলেটারী দের সঙ্গে মেশো? গত বুধবার গাছতলায় থাকা অল্প বয়েসী খোদেজা পাগলীরে নাকি গঞ্জের মেলেটারী গো কাছে নিয়া গেছো? কি করছ তারে নিয়া? সে আর ফির‍্যা আহে না ক্যা...সত্যি কইরা কও...!’
শফিক জবাব দেয়না। কাচুমাচু করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। আস্তে আস্তে, নূরী সব বুঝতে শিখে ফেলে। সারাদিন শুধু কাঁদে। মানুষের মুখেও সব শোনে। চোখের পানি ছাড়া তার এ দুঃখে আর কেউ সঙ্গী নেই।
দিন দিন গ্রামের পরিস্থিতি আরো খারাপ হচ্ছে।মিলিটারীরা গঞ্জের ক্যাম্প থেকে তেমন একটা বেরোয়না। কারন মুক্তিরা নাকি অনেকগুলোকে মেরে ফেলেছে। এই গ্রাম থেকেও কয়েকজন ছেলে নাকি মুক্তিবাহিনীতে তে যোগ দিয়েছে। যাদের ছেলেরা মুক্তি বাহিনীতে যোগ দিয়েছে, তাদের বাবা মার উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার হয়েছে, ঘরের টিন খুলে নিয়ে গেছে, গরুছাগল নিয়ে গেছে। মুরুব্বীদের পরামর্শে এসব বাড়ীর বৌ ঝিদের অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। নূরী সব খবরই পায়। যখন শোনে সব কিছুর সঙ্গে তার স্বামী শফিকের নাম আসে, তখন তার আর মুখে অন্ন রোচেনা। শুধু কেঁদে চলে। এদিকে আজকাল নূরীর শরীরও ভাল যাচ্ছেনা। সারাদিন বমি করে আর ওয়াক টানে। নূরীর বুঝতে কিছু বাকী থাকেনা। এক একবার ভাবে যদি ওটা নষ্ট হয়ে যেত, তাহলে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করতো। পাপীর সন্তান পেটে রাখতে সে চায়না।
নভেম্বরের দিকে এলো সেই কালসন্ধ্যা। বাড়ীর লাগোয়া ঘন পাটক্ষেত। শফিক একটা ডুরে শাড়ী পরা অল্পবয়সী মেয়েকে টেনে হিঁচড়ে ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে শিকল টেনে দেয়। হতবিহ্বল নূরী জিজ্ঞাসা করে...‘এইডা কে,...
হ্যারে ক্যান বাসায় আনল?’  শফিক আমতা আমতা করে বলে...‘আর জাগা পাইলাম না...সব খানে চিল্লাচিল্লির শব্দ বাইরে যাইতে পারে...এইডা বিল্ডিং.... শব্দ হইলেও বাইরে যাইবোনা...রেজাকার কমান্ডার সাব রে খুশী করন লাগবো।....আমি অহন যাইতাছি...আরেকটু রাত হইলে উনি আইবো....
তুমি শুধু কমান্ডার সাবরে ঘরে ঢুকাইয়া দিবা....যা কই তাই করবা’...বলে হনহন করে বেরিয়ে যায়...! নূরী শুধু চেঁচিয়ে বলতে পারে..‘তুমি এই পাপের কাজ আমগো বাইত করবা? হে আল্লাহ !’  শফিক চেঁচিয়ে বলে...
‘অন্য কিছু করলে তোরে বটি দিয়া দুই টুকরা কইরা ফালামু, হারামজাদী।’
নূরী দাওয়ার উপর আছড়ে পড়ে অঝোরে কাঁদতে থাকে।
সন্ধ্যা হওয়ার আগে আগে নূরী শিকল খুলে সন্তর্পণে ঘরে ঢোকে হ্যারিকেন নিয়ে। ঘরে ঢুকতেই  একটা চৌদ্দ পনেরো বছরের  মেয়ে নূরীর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কেঁদে কেঁদে চোখ লাল। বলে...‘আপনি আমার মা, আমি আপনের মেয়ের লাহান...আমার ইজ্জত বাঁচান,...তিনদিন পর আমারে বরপক্ষ দেখতে আইবো...মা গো...আপনে আমারে বাঁচান। আমার এই ক্ষতি আপনেরা কইরেন না।’  নূরীও কাঁদছে। একটু পরে নিজের চোখ মুছে ফেলে.....হ্যারিকেন তুলে বলে...‘তুই গঙ্গাকাকার মাইয়া শিউলী না?...তোরে ধইরা আনছে হারামী ডায় ? হায় আল্লাহ...আমি কীভাবে তোর এহোন বাঁচাই...!’
পরক্ষণেই মন স্থির করে নেয় নূরী। কিছু গুড় চিড়ামুড়ি বাঁধে এক বড় পোটলায়। এতদিনের জমানো ভর্তি মাটির ব্যাংক এক আছাড়ে ভেঙে সব যা ছিল তাও এক পোটলায় বাঁধে। শিউলীকে বুকে জড়িয়ে ধরে আবার কেঁদে ফেলে নূরী। বলে.....‘মা' যখন ডাকছস... তোর কিচ্ছু হইবোনা, নিশ্চিন্ত থাক। এই গুলা নিয়া অক্ষনই বাইত গিয়া, তালা দিয়া গঙ্গা কাকারে নিয়া দূরে কোথাও যাবি গা। দ্যাশ স্বাধীন হইলে ফিরবি, যা....ভাগ ! দৌড় দে...যা জলদি কর।’ পাটক্ষেত দিয়ে বের করে দেয় শিউলীকে। যতদুর পাটক্ষেত নড়াচড়া করে ততক্ষণ দাঁড়িয়ে পাহারা দেয় নূরী। আবার চোখ মুছে আল্লাহর 
শুকরিয়া আদায় করে।
সন্ধ্যার পরে শফিক রাজাকার কমান্ডার কে নিয়ে আসে। কম্যান্ডারের কাঁধে কালো রাইফেল।
শফিক দূরে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলে.....‘আমি গঞ্জে যাইতাছি। মেলেটারী স্যার খবর দিছে...আইতে রাইত অইবো.....কমান্ডার স্যারের যেন কোন অযত্ন য্যান না হয় দেহিস.....!’  বলেই দৌড়ে চলে যায় শফিক।
নূরীর মধ্যে কোনো ভাবান্তর নেই। বাড়ী পুরাই অন্ধকার। কমাণ্ডার দহলিজ ঘর ছাড়া কিছুই দ্যাখেনি। নূরী অন্ধকারের মধ্যে আস্তে করে দরজা খুলে ঘরে যেয়ে খাটে শুয়ে থাকে। রাজাকার কমান্ডার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। নুরীর অভ্যস্ত শরীরে কিছুই হলোনা। শুধু মিনিট পাচেক দাঁত কামড়ে পাশবিক খামচা-খামচি সহ্য করে রইলো। খানিকপর কমান্ডার, ঘরের কোনা থেকে রাইফেল তুলে প্যান্ট পরে চলে গেল। সে চলে গেলে নূরী মাটি থেকে শাড়ী ব্লাউজ পেটিকোট কুড়িয়ে নিয়ে সাবান আর ধুন্দলের গা ঘষা খোসা নিয়ে নির্বিকার ভাবে পুকুর ঘাটের দিকে চললো। তার গা ঘিন ঘিন করছে। কিন্তু, কী আশ্চর্য মনে কোনো পাপ বোধই হচ্ছে না। কচি মেয়ে শিউলীর বুকফাটা আর্তনাদ যে শুনতে হয়নি, সেই তার পরম ভাগ্য। 
 
একবার ভেবেছিলো পাশের আমড়া গাছের ডালে গলায় দড়ি দিয়ে মরে। কিন্তু পেটের টার কথা মনে পড়লো, তার তো আর কোনো দোষ নেই । আবার ভাবলো...না....দিন এমন থাকবেনা, দেশ স্বাধীন হবেই। স্বাধীন দেশ কে, স্বাধীন জাতিকে, সবাই কে এ ঘটনা বলে যেতে হবে, জানাতে হবে। অন্ততপক্ষে, শফিক কে তো বটেই। সে অন্তত জানুক তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত নূরী কিভাবে করেছে। তার পাপের বিচার হোক বা না হোক, স্বামীর পাপের তো শোধ নেয়া হলো। যতদিন শফিক বেঁচে থাকবে, ততদিনই সে এই শোধের সাক্ষী হয়ে থাকুক। অনেকদিন পর নূরীর আজ নিজেকে খুব হাল্কা বোধ হচ্ছে।।

একক কবিতা সন্ধ্যা



মহুল ওয়েব প্রকাশিত বিভিন্ন সংখ্যা



করোনা Diary



আমাদের কথা

আমাদের শরীরে লেপটে আছে আদিগন্ত কবিতা কলঙ্ক । অনেকটা প্রেমের মতো । কাঁপতে কাঁপতে একদিন সে প্রেরণা হয়ে যায়। রহস্যময় আমাদের অক্ষর ঐতিহ্য। নির্মাণেই তার মুক্তি। আত্মার স্বাদ...

কিছুই তো নয় ওহে, মাঝে মাঝে লালমাটি...মাঝে মাঝে নিয়নের আলো স্তম্ভিত করে রাখে আখরের আয়োজনগুলি । এদের যেকোনও নামে ডাকা যেতে পারে । আজ না হয় ডাকলে মহুল...মহুল...

ছাপা আর ওয়েবের মাঝে ক্লিক বসে আছে। আঙুলে ছোঁয়াও তুমি কবিতার ঘ্রাণ...