procchod heontor mohool

সাড়ে তিনশো বছরের প্রাচীন পুজোর একটুকরো ।। পাপিয়া ভট্টাচার্য

WhatsApp Image 2018 10 04 at 23.19.09

 সাড়ে তিনশো বছরের প্রাচীন পুজোর একটুকরো
 পাপিয়া ভট্টাচার্য

 

 সারাদিন অসহ্য একটা গুমোটের পর ভোররাতে বৃষ্টি নামল। তার মানে আর একটু পরেই শুরু হবে দুর্দান্ত একটা ভিজে ভিজে সকাল। টিনের চালে শব্দ হচ্ছে ঝমঝম ঝমঝম। এই শব্দটার সঙ্গে বহুদূর থেকে একটা চেনা সুর ভেসে আসে, খুব মনকেমন করা, খুব আপন করে জড়িয়ে নেওয়া একটা সুর। ওই ঝমঝম শব্দ আর এই সুর, দুয়ের লোভে দেশের বাড়ির এই পুরোনো অংশের গন্ধ ছেড়ে নতুন তৈরি হওয়া সুন্দর বাড়িটার সাজানো ঘরগুলো আমাকে একটুও টানে না। পেছনের ছোট্ট বাগানের চাঁপা আর অমলতাস গাছ পেরিয়ে তীর্থসায়রের ঘাট, আর তার ওপরে বিস্তৃত মাঠ, সব মিলিয়ে আমার এই পুরোনো একার ঘরখানা এত সম্পূর্ণ যা থেকে কিছু মাত্র বাদ গেলেও জায়গাটা আমার অচেনা হয়ে যাবে। খাটের পাশের এই জানালাটায় বসে দূরের ওই শান্তিপুরের মাঠ পেরিয়ে বৃষ্টির ঝাপসা হয়ে ছুটে আসা দেখেছি কতবার। আর এখন এই ঘুম ঘুম চোখে বৃষ্টিভেজা এক ঝলমলে সকাল হতে দেখা এত আনন্দের যে গত দুদিনের নির্ঘুম রাতের কথা মনেই পড়ছে না।


দেশের বাড়িতে এসেছি মাত্র দুদিন হল। পুরোনো বাড়ির এই ঘরটাতেই থাকব জেদ করায় আঙুর কাকিমা আমাকে পাহারা দিতে এসেছে। আঙুর আমাদের বহুদিনের ভোগ রান্নার লোক। 'ভয় পেয়ো নি, আমি তো আছি' বলে এমন ঘুম তার সে সারারাত টিনের চালে খটখাট দুমদাম শব্দ, আমার বারবার ওঠা বসা, কোনোকিছুতেই হেলদোল নেই। কুমার, দেশের বাড়ি সারাবছর যার দায়িত্বে থাকে, সে অবশ্য বলেই দিয়েছিল, ইঁদুর লাফায় টিনের চালে, পেয়ারা খসে পড়ে শব্দ হয়।


আমার মনে পড়ল, কাল সারা বিকেল ধরে যত্ন করে আল্পনা দিয়েছিলাম উঠোনে, সব ধুয়ে যাচ্ছে। পূরবে আলোর সাথে পড়ুক প্রাতে দুই নয়ানে !


নতুনমা উঠে পড়েছেন চটির অস্থির ফটফট শব্দ তুলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। দেশের বাড়িতে চটি পরার রেওয়াজ ছিল না কিছুদিন আগেও। গাড়ি থেকে নেমেই জুতো খুলে ফেলে খালি পায়ে দুর্গাদালান আর সঙ্গে সঙ্গে সেগুলি চালান হত সিঁড়ির তলায়। বাকি দিনগুলি আমরা জুতো নামক বস্তুটির কথা বেমালুম ভুলে দিব্যি ঘুরে বেড়াতাম ধুলোকাদা মেখে। মনে পড়ত সেই ফেরার দিন। বস্তাচাপা ধুলোভরা জুতোগুলি বের করে দিচ্ছে আমাদের পুরোনো লোক ন'বউ, আমরা 'আরে, এটা আমার নয়', 'দূর, বাঁ পায়ের জুতোটা কোথায় গেল' করে সম্মিলিত চেঁচামেচি জুড়েছি আর অতি শান্ত ন'বউ একটি কথাও না বলে নিজের থানের আঁচল দিয়ে ধুলো মুছে এগিয়ে দিচ্ছে জুতোগুলি, এতো এই সেদিনের কথা যেন !

 

ন'বউ কবে চলে গেছে, জুতোও ওখানে থাকে না আর। হঠাৎ কোনোদিন ওপরে ওঠার সময় ওই জায়গাটায় চোখ পড়লে ওর কথা মনে পড়ে। সারাদিনের কাজ শেষ করে ছোট্ট লণ্ঠনটি দুলিয়ে বাড়ি ফিরছে ন'বউ, বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওই একটুখানি আলোর দুলতে দুলতে দূরে যাওয়া দেখে কত কী কল্পনা করতাম !


ঝিরঝিরে বৃষ্টির সঙ্গে পাক খেয়ে ওপরে উঠছে ধোঁয়া। দুটো আঁচ একসঙ্গে ধরিয়ে দিয়েছে মল্লিকা। স্নান করতে যেটুকু সময়, দৌড়ে আসতেই গনগনে আগুন, ভোগ বসে গেল। নতুন মা হায় হায় করছেন, কখন কি হবে ! উঠোনের ওপর আমার আল্পনা ভোরের বৃষ্টিতে অর্ধেক ধুয়ে গেছে, বাকিটুকু পড়ে থাকা ঝরাপাতার সঙ্গে ঝেঁটিয়ে বার করে দিতে দিতে সারথি বলল, গোল করো নি দিনি, সব হবে ! সবেতে টেনশন করলে হয় !


সারথি আজকাল কথায় কথায় ইংরেজি বলে। একটু আগেই বাসন ধুয়ে আসতে আসতে মেঝেতে বাটি পড়ে গেল একটা, ও আমার দিকে তাকিয়ে বলল, সরি।


একমেটে প্রতিমার কাঠামোয় মাটি পড়বে আজ রথের দিনে। বিশেষ অনুষ্ঠানগুলোতে আমরা দেশের বাড়ি আসি। উলু, শাঁখ, কাঁসরঘন্টা বাজছে। বাড়ির সবচেয়ে বর্ষীয়ান মানুষ কাকু কাঠামোয় প্রথম মাটি ছোঁয়ালেন। দালানের বাইরে শ্যাম মিস্ত্রী আমাকে বোঝাচ্ছেন কিভাবে কাঠামোর ওপর প্রথম খড়কুটি মেশানো মাটির একমেটে হবে। দোমেটেতে চটকুচি মেশানো মাটি চাপানো হবে তার ওপর। প্রতিমার আঙুল? ও তো মাটির সঙ্গে তুলো মিশিয়ে। এতে ইচ্ছেমত মোড়া যায় আঙুল।


ভাল শ্রোতা পেয়ে শ্যাম দা খুব খুশি। আমাকে ভালওবাসেন খুব। অনেক বছর ধরে ঠাকুর গড়ছেন এবাড়ির সাড়ে তিনশো বছরের প্রাচীন পুজোটির।


পুরোহিত নিখিল কাকার সঙ্গে, উনি আবার স্কুল শিক্ষকও, জোর তর্ক চলছে তন্ত্রধারক নন্দদার। নারায়ণ পুজোয় বেশি ফুল থাকা দরকার কেন ! আমাকে সাক্ষী মানলেন নিখিলকাকা। এই তো পাপিয়া আছে, ও ও জানে ! বইটই পড়ে তো অনেক ! কি গো পাপিয়া, সাদা ফুল...!


আমি তাড়াতাড়ি ঘাড় নাড়লাম, জানি না। এ বিষয়ে আমি আমার বাবার মতো, গাছের ফুল গাছেই রাখতে ভালোবাসি। লাল সাদা কোনো ফুলই ছিঁড়ে কারো পায়ে দিতে ইচ্ছে করে না।


রাসভোগ বাড়তে বাড়তে আমার মনে পড়ছে বড়দাকে। পিসতুতো ভাসুর আমার ভোগে আমাকে দেখলেই উঠোন থেকে মজা করে চেঁচাতেন, এই খেয়েছে, ভোগে আজ পাপিয়া নাকি ! মা দুর্গা সময়ে খেতে পাবে তো আজ !


বলা নেই, কওয়া নেই, দুম করে চলে গেলেন বড়দা। পূর্ণাহুতির সময় কাকাজীর চোখে কি ওপারে গিয়েও জল পড়ে ! সপ্তমীর ঘট তোলার সময় পূর্ণ ঘট কাঁখে নিয়ে বড়মা বলতেন, দ্যাখো দ্যাখো, আশি বছরের বুড়ি আমি,এখনও...। আর তোমরা সব ষোলো বছরেই..!


আশির নিচে সবাই ষোলো বড়মার কাছে। পুজোটা এখনও ফাঁকা লাগে বড়মা ছাড়া।


আকাশে আবার মেঘ জমেছে। মেঘের পরে মেঘ, আঁধার করে আসে ! খাওয়া শেষ হতে না হতেই মেঘের ছায়া জমাট সন্ধে নামিয়ে দিল। আঙুর কাকিমা ঘরে ঘরে ধুনো দিতে দিতে বলছে,রথের দিন, বৃষ্টি হবেনি।


আমার পুরোনো ঘরের প্রিয় জানালায় বসে আছি। চাঁপা, অমলতাস ভিজে ভিজে বেশ ছায়া ঘনাইছে বনে বনে ! বিদ্যুৎ চলে গেছে, দালানের ভেতর। হ্যাজাক জ্বেলে একটু একটু করে প্রতিমা নির্মাণ করছেন শ্যামদা। দালানের ওই আলোটুকু ছাড়া গ্রামের সবখানে নিভৃত রজনী অন্ধকার ! টিনের চালে মধুর ঝমঝম শব্দ। আহা, শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে..., তোমার ওই সুরটি আমার...!

 

  (স্মৃতিকথাটি মহুল উৎসব সংখ্যা ১৪২০ থেকে সংগৃহীত )

কবি প্রণাম : হে অন্তর



Card image




কবি প্রণাম : হে অন্তর   দেখেছেন : 1676

‘চিরসখা, ছেড়ো না মোরে..’ ।। আনন্দরূপ নায়েক
Anandrup Nayek।। আনন্দরূপ নায়েক

    পুরাতন বিকেল পেরিয়ে হলুদ ফুলে ভরা বাবলা গাছের সারি। চলে যাওয়া মাটির রাস্তাটি পায়ে পায়ে ঢুকে পড়ে প্রিয় বাড়িটির ভেতর। সাঁঝ নেমে আসে। দখিনের বায়ু বয়। মৃদু আলো জ্বলে ওঠে। এক একদিন বাবা তার হারমোনিয়াম নিয়ে বসে। গান গায় একের…

May 7, 2020
Card image




কবি প্রণাম : হে অন্তর   দেখেছেন : 3194

যে-অন্ধ বৃষ্টি আনতে যাচ্ছে ।। সুকান্ত সিংহ
Sukanta Sinha ।। সুকান্ত সিংহ

    আমার কিছু অনিবার্য বিষণ্ণতা ছিল। আমার কিছু অনিবার্য বিপন্নতা ছিল। আমার কিছু অনিবার্য আকুলতা ছিল। ছিল। আছে। থাকে। হ্যাঁ, আমার কিছু অনিবার্য আশ্রয়ও ছিল। সেই যে শিলাবতীতে নৌকো বাঁধা থাকত, আমি বাসের জানলা দিয়ে দেখতে পেতুম, তারা দুলছে জলের ঢেউয়ে…

May 7, 2020
Card image




কবি প্রণাম : হে অন্তর   দেখেছেন : 2136

বন্ধু, রহো রহো সাথে...।। পাপিয়া ভট্টাচার্য
Papia Bhattacharya ।। পাপিয়া ভট্টাচার্য

     মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে এরকম স্থবির একটা সময়ের ভেতর আছি। দিন মাস সব গুলিয়ে গেছে, ঝিমিয়ে কাটছে সময়। রোজ ভাবি, আজ যেন কী বার!  কত তারিখ! কিছুতেই মনে আসে না  সহজে। তার মধ্যে এই একটা সপ্তাহ  যেন  একদম…

May 7, 2020
Card image




কবি প্রণাম : হে অন্তর   দেখেছেন : 3479

যার নাম রোদ ।। লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল
Laxmikanta Mandal ।। লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল

           'তবে পরানে ভালোবাসা কেন গো দিলে              রূপ না দিলে  যদি বিধি হে ' -  এ আক্ষেপ নিজের কাছেই । ভালোবাসা চাই  - ভালোবাসা চাই  - ভালোবাসতে চাই - ভালোবাসতে চাই , আজ চিৎকার করে বলতে হচ্ছে । …

May 7, 2020
Card image




কবি প্রণাম : হে অন্তর   দেখেছেন : 3338

‘চিরটাকাল সঙ্গে আছে জড়িয়ে লতা’ ।। প্রিয়াঙ্কা
Priyanka ।। প্রিয়াঙ্কা

      শব্দের অভাব বোধ হয়, সমুদ্রের বা আকাশের মতো অনন্তের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে। তাঁকে নিয়ে কিছু না লিখতে যাওয়া মানে ঠিক তাই। যাকে বাঙালীর বেশ বড় একটা অংশ একটা অলিখিত ব্যাকরণ বইএর ভেতর রেখে দিয়েছে।  স্বরলিপির অক্ষরের মধ্যে রেখে দিয়েছে। পাঞ্জাবী…

May 7, 2020
Card image




কবি প্রণাম : হে অন্তর   দেখেছেন : 1700

আমাদের রবীন্দ্রনাথ ।। সোমনাথ শর্মা
Somnath Sharma ।। সোমনাথ শর্মা

  রবীন্দ্রনাথ। এই ভদ্রলোক সম্পর্কে আমাকে লিখতে হবে! কঠিন কাজ। ও কাজ আমি করব না। আমি যাদের চিনি তাদের নিয়ে লিখব। রবীন্দ্রনাথকে আমরা কত ভালোবাসি তার সপ্রমাণ ব্যাখ্যায় যাব খানিকটা। একজন লেখক বা যে কোনো পেশার সৎ লোক মনীষী হয়ে ওঠেন তাঁর…

May 7, 2020
Card image




কবি প্রণাম : হে অন্তর   দেখেছেন : 2842

ব্যক্তিগত অন্তরকথন ।। অমিত মাহাত
Amit Mahata ।। অমিত মাহাত

    মা শালপাতা তুলে আনত বন থেকে। সেলাই করত। অন্যের বাড়িতে কখনও ধানসেদ্ধ চাল পাছড়ানো থেকে কাজে ভোজে ছোঁচগোবর সাফসুতরা। আমার তখন অতি অল্প বয়স। মা কাজে চলে যেত। সকালে। ফিরত সাঁঝে । আমার হাতে দেদার সময়। কীভাবে যে খরচা হত …

May 7, 2020
Card image




কবি প্রণাম : হে অন্তর   দেখেছেন : 3838

ঘরের ডাক ।। কেশব মেট্যা
Keshab Metya ।। কেশব মেট‍্যা

  ‘পিসেমশায়! আমি কি ঐ উঠোনটাতেও যেতে পারব না?' –এই শব্দবন্ধ আজ  যেন বুকের মাঝে বারংবার ছ্যাঁৎ করে ছুঁয়ে যাচ্ছে । অমলের মতো কতো কোমলমুখের এখন এই একটাই আর্তি। দেওয়াল তোলা বর্গফুটের কারাগারে অসুখভয়ে বদ্ধ শৈশব। নির্ঘুম রাস্তার বুকেও শ্মশানের নিস্তব্ধতা।  নিজের…

May 7, 2020
আরও পড়ুন

কবি প্রণাম : হে অন্তর- সংখ্যায় প্রকাশিত লেখা সমূহ



একক কবিতা সন্ধ্যা



মহুল ওয়েব প্রকাশিত বিভিন্ন সংখ্যা



করোনা Diary



আমাদের কথা

আমাদের শরীরে লেপটে আছে আদিগন্ত কবিতা কলঙ্ক । অনেকটা প্রেমের মতো । কাঁপতে কাঁপতে একদিন সে প্রেরণা হয়ে যায়। রহস্যময় আমাদের অক্ষর ঐতিহ্য। নির্মাণেই তার মুক্তি। আত্মার স্বাদ...

কিছুই তো নয় ওহে, মাঝে মাঝে লালমাটি...মাঝে মাঝে নিয়নের আলো স্তম্ভিত করে রাখে আখরের আয়োজনগুলি । এদের যেকোনও নামে ডাকা যেতে পারে । আজ না হয় ডাকলে মহুল...মহুল...

ছাপা আর ওয়েবের মাঝে ক্লিক বসে আছে। আঙুলে ছোঁয়াও তুমি কবিতার ঘ্রাণ...