স্বাদহীন স্বাধীনতা ।। তৈমুর খান

swadhinota
–আমরা কি স্বাধীন?
–হ্যাঁ আমরা স্বাধীন। ১৯৪৭ সালের ১৫ই অগাস্ট আমরা স্বাধীনতা পাই।
–ওটা স্বাধীনতা নয়, ক্ষমতা হস্তান্তর। ব্রিটিশরা ভারতকে ভাগ করে ক্ষমতা হস্তান্তর করে গেলেন মাত্র। আমরা একই শাসনের ভেতর পাল্টানো শাসককে পেলাম। ব্রিটিশ শাসকের বদলে এল ভারতীয় শাসক।
–এতো অদ্ভুত কথা! আমরা তো স্বাধীনতা দিবস পালন করে আসছি। বড় বড় বক্তব্য রাখছি। 'সারে জাঁহা সে আচ্ছা হিন্দুস্তান হামারা' গাইছি। পতাকা ওড়াচ্ছি। এসব কি তবে ফালতু?
–একেবারে সব ফালতু। স্বাধীনতার নামে ব্রিটিশরা একটা জাতিকে ধ্বংস করার ফর্মুলা ছড়িয়ে গেছে। ফর্মুলা প্রয়োগ করেছে দ্বিজাতিতত্ত্বের দেশভাগে। আর তো চিরকাল ধরেই হানাহানির রূপে বিরাজ করবে। দেশের অভ্যন্তরেও জাত-ধর্ম-সম্প্রদায় নিয়ে হানাহানি। দেশের বাইরেও জাত-ধর্ম নিয়ে হানাহানি। এ যেন বিশাল ও সর্বব্যাপী এক হিংসাবৃক্ষ। এর ছায়া মোহনীয় নয়। আপাতত সুখের ও স্বপ্নের। ভোগের ও আত্মচরিতার্থের মনে হলেও তার পরতে পরতে বিষ। দেশের সুবিধাবাদী রাজনৈতিক দল এর ফল ভোগ করবে। এর সুখ চরিতার্থ করবে। ফর্মুলা প্রয়োগ করে তামাম বুদ্ধিবাদীর মাথা গুলিয়ে দেবে। কেউ বুঝতে পারবে না।
–তাহলেও তো গণতন্ত্র আছে। নির্বাচন হয়। জনগণ ইচ্ছে করলে এইসব শাসকদের কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে পারে।
–না তা পারে না। জনগণ তো একদল মাছির মতো। লোভের রস ছড়িয়ে দিলে তা ভালো কী মন্দ, গুড় না গু তা তারা বিচার করে না। ভনভন শব্দ করে তাতে বসে। চেটে চেটে দ্যাখে। লোভের জিহ্বায় তখন স্বাদ নেবার বদলে চাটাচাটির ভক্ত হয়ে যায়। বিস্বাদও স্বাদু ঠেকে তাদের কাছে। মৃত্যুও একপ্রকার জীবন তখন।
–তাহলে কি ব্রিটিশদের থেকেও খারাপ এরা?
–একেবারে যথার্থ কথা। ব্রিটিশদের একটা আলাদা ঘরানা ছিল। জাতির বিনাশ তারা করেছিল রাষ্ট্রীয়ভাবে। বৈষম্য নীতি প্রয়োগ করে। কিন্তু এখন যা করছে তা মূলত অন্তর্ঘাত। মানুষকে শোষণ করে, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে কয়েকজনমাত্র পুঁজিপতির তাঁবেদার করছে। ধর্মীয় সন্ত্রাস, বিভেদ ও অস্পৃশ্যতাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে মদত দিয়ে সংবিধানকে নামমাত্র রেখে জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করছে।
–কেন জনগণ কি মৌলিক অধিকার ভোগ করে না?
–আজ রাষ্ট্রীয়ভাবে মৌলিক অধিকারকে কেড়ে নিচ্ছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের লোকেরা। ইচ্ছেমতো ধর্মাচরণ করা, আবার নাস্তিক হওয়া, যেকোনো স্থানে বসবাস করা, নিজের রুচিমতো খাদ্য গ্রহণ করা এবং বাক্ স্বাধীনতার অধিকার কি আজ ভারতে আছ? অলিখিতভাবেই এগুলি দমন-পীড়নের মাধ্যমে সংকুচিত করা হচ্ছে।  সংসদে এমন আইন পাস করিয়ে নেওয়া হয়েছে যার বলে যেকোনো সময় যে কোনো ব্যক্তিকে বিনা  কারণেই গ্রেপ্তার  করে জেলে পাঠানো যাবে। আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ দেওয়া হবে না। আবার এমনও আইন আসতে চলেছে প্রতিটি নাগরিককেই তার নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হবে। যে প্রমাণ সরকার চাইবে। সংকীর্ণতা ও আঞ্চলিকতার নানারূপ মাথাচাড়া দিচ্ছে। ভাষাগত ও ধর্মগত, সংস্কার ও কুসংস্কারগত  বিভেদ জোর করে জাতির ওপর চাপানো হচ্ছে। ভারতবাসীর ভারতীয়ত্ব এতে ক্ষু্ণ্ণ হচ্ছে। ধ্বস্ত হচ্ছে। জাতীয় আবেগকে সুগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করার বদলে তা খণ্ডিত ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। ইচ্ছেমতো আইন দ্বারা কোনো কোনো সম্প্রদায়কে কোণঠাসা করার কৌশলও ভাবা হচ্ছে। কোথায় স্বাধীনতা?
–তাহলে আজও আমরা পরাধীনও?
–আমরা তো পরাধীনই। মুক্তির আনন্দ আমাদের নেই। স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারত সন্তানেরা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। চরম ত্যাগ ও  কৃচ্ছ্রসাধনায় তাঁরা প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু কুচক্রী রাষ্ট্রবিদদের হাত থেকে দেশের অখণ্ডতা রক্ষা করতে পারেননি। একটা ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতান্ত্রিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে সংবিধান রচনা করেছেন তার মর্যাদা রক্ষার্থে ঠিকমতো  প্রয়োগ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেননি। সেই প্রচেষ্টাও নেই। নির্বাচনে অসদুপায় অবলম্বন করে ক্ষমতা দখল, জনগণের সুখ-সুবিধাকে পদে পদে উপেক্ষা করে পরোক্ষে নিজেদেরই স্বার্থসিদ্ধির ব্যাপারটা বড় হয়ে উঠেছে। দেশের উন্নয়ন নয়, জনগণের আর্থসামাজিক পরিকাঠামোর সমৃদ্ধি নয়, কতিপয় ব্যক্তির উন্নয়নই লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং দেশ আজ একটা কুচক্রী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বিজ্ঞান ও যুক্তি, সত্য ও মানবতার যেখানে দরকার, সেখানে দুর্নীতি ও বিদ্বেষের কলাকৌশলই জাল বিস্তার করে চলেছে। এখনো মানুষের দারিদ্র্য দূর হয়নি। শিক্ষার আলো সর্বত্র পৌঁছায়নি। জাতীয় নেতার প্রতি জাতির যে আবেগ জেগে ওঠে তাও জাগরিত হয়নি। চাকরির, শিক্ষার, বসবাসের এবং যাতায়াতের জন্য বিভিন্ন ফরম ফিলাপ করতে গিয়ে জাতি ধর্মের উল্লেখ করতে হয়। ভারতবাসীকে ভারতবাসী হিসেবে না দেখে সম্প্রদায় হিসেবে চিহ্নিত করা হয় ও বিচার করা হয়। বৃহত্তর মানবের শরিক হিসেবে ভাবা হয় না। ভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রেমের বিবাহকে তাই 'লাভজিহাদ' নাম দেওয়া হয়। ইচ্ছেমতো স্থানে বসবাসের অনুমতিও পাওয়া যায় না। নিষিদ্ধ কোনো খাদ্য না গ্রহণ করলে তাকে হীন প্রতিপন্ন করা হয়। নাম ও সম্প্রদায়  দেখে 'দেশদ্রোহী' আখ্যা দেওয়া হয়।
–আমাদের তো তাহলে আতঙ্কিত অবস্থা!
–একেবারে কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা চলেছি। পথে-ঘাটে বাড়িতে মাঠে যেকোনো সময়ই কারো দ্বারা আমরা আক্রান্ত হতে পারি। 'উঁচুজাত' 'নিচুজাত' এর বিভেদ রেখা ভারতবর্ষের শিরায় শিরায় উপস্থিত। আমাদের জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই। দাবি জানানোর, অভাব-অভিযোগ করার, সঠিক বিচার প্রার্থনারও পরিবেশ কি ভারতে আছে? রাজনৈতিক দলের অর্থাৎ শাসকের মনের মতো চলতে হবে তাদের  মনোরঞ্জন করে। অন্যথায় 'দেশদ্রোহী' ঘোষিত হবারই সম্ভাবনা। শাসকদল একদল লোকও নিয়োগ করে রাখে, যারা সমাজে ত্রাস সঞ্চার করে চলে । আমাদের ইচ্ছা না থাকলেও তাদের সমর্থন করতে হয়। বিরোধিতায় সমূহ বিপদ। বিরোধী দল ও শাসক দলের কূটকৌশলে তাদের সমঝোতা থাকে তাদের অন্তর্গত অপ্রকাশ্য কয়েকটি চুক্তিতে। শুধু জনগণই বিপদে পড়ে। তারা দিশেহারা হয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতেও ভুলে যায়। ওই যে বললাম একদল মাছির মতো শুধু ভনভনই তাদের সম্বল। মেরুদন্ড কারও নেই। সুতরাং খুনিরও বিচার হয় না। আবার সৎ ব্যক্তিও ফাঁসিতে ঝোলে। আমাদের যেন বিবেককে জাগাতে পারি না। তাকে ঘুমিয়ে রাখি। হাওয়া যেদিকেই বহে সেদিকেই পতাকা উড়িয়ে দিই। পা-চাটা আমাদের জিহ্বা। পা চেটে চেটে স্বাদহীন। বেঁচে থাকি, নিশ্চিন্তে থাকি এক গড্ডালিকা প্রবাহী জাতকের মতোই।
–ভারতবাসী হিসেবে তাহলে কি আমাদের গৌরব নেই?
–অবশ্যই গৌরব আছে। সেই গৌরব আমরা অর্জুন করতে চলেছিলাম নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মাধ্যমে। তিনি প্রকৃত স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন স্বাধীনতার। প্রকৃত বীরের মতোই অর্জন করতে চেয়েছিলেন স্বাধীনতা, ভিক্ষা করতে চাননি। কিন্তু আমরা যে স্বাধীনতা পেয়েছি তা ভিক্ষালব্ধ। জিন্নাহ ও জহরলালের রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে আর তাই হয়েছে দেশবাসীর দুঃস্বপ্নের কারণ। দুঃস্বপ্ন ভর্তি দেশ সেখানে কোথায় স্বর্গীয় আভাস? দেশবাসী তাই দেশপ্রেম শেখেনি। মানবতাবাদের অনুশীলন করেনি। জাতিসত্তার সর্বব্যাপী স্বপ্ন দেখতে জানে না। যে মনীষীরা পথ দেখাতে এসেছেন তাঁদের আদর্শ ও ত্যাগকেও মর্যাদা করতে পারেনি। বরং বিকৃত অর্থ করেছে। সংকীর্ণতায় ভরিয়ে তুলেছে। চিরন্তন আদর্শকে গোষ্ঠীর আদর্শে পরিণত করেছে। সর্বোপরি একদল উচ্ছৃঙ্খল জনতায় পরিণত হয়েছে। সুতরাং আমাদের বিকাশ হয়নি। শোষণ-বঞ্চনা-পীড়নের অবসান ঘটেনি। 'ভারত আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে' একথা অধরাই থেকে গেছে। আজকের স্বাধীনতা দিবসে তাই যে কবিতাটি আমরা লিখতে পারি:
স্বাধীনতা দিবস 
-------------------------
সারারাত মেঘ ছিল, মেঘের গর্জন 
একটি সকাল দেখি ফেলে গেছে 
বৃষ্টি নয়, যুদ্ধ ধ্বংস-গান... 
আতঙ্কের রোদ উঠেছে মাঠে 
রক্ত শিশিরে বেজে উঠছে কণ্ঠস্বর 
কসাইয়েরা সারি সারি খুলেছে দোকান 
বিশ্বাসেরা পলাতক। ওদের ধরার জন্য 
সবাই তৎপর । 
বাহিনী নেমেছে রাস্তায় —
কোনও কোনও কসাইয়েরা 
আমাদের শান্তিকমিটির লোক । 
কী সুন্দর পতাকা উড়ছে 
মানুষের মাংস খেতে এসেছে বাঘ ! 
কী সুন্দর পোশাক — থাবা-দাঁত-চোখ 
দেখা যাচ্ছে না —
শুধু মাইকে শুনতে পাচ্ছি, পার হল 
আর একটি স্বাধীনতা দিবস !
 
 
 

একক কবিতা সন্ধ্যা



মহুল ওয়েব প্রকাশিত বিভিন্ন সংখ্যা



করোনা Diary



আমাদের কথা

আমাদের শরীরে লেপটে আছে আদিগন্ত কবিতা কলঙ্ক । অনেকটা প্রেমের মতো । কাঁপতে কাঁপতে একদিন সে প্রেরণা হয়ে যায়। রহস্যময় আমাদের অক্ষর ঐতিহ্য। নির্মাণেই তার মুক্তি। আত্মার স্বাদ...

কিছুই তো নয় ওহে, মাঝে মাঝে লালমাটি...মাঝে মাঝে নিয়নের আলো স্তম্ভিত করে রাখে আখরের আয়োজনগুলি । এদের যেকোনও নামে ডাকা যেতে পারে । আজ না হয় ডাকলে মহুল...মহুল...

ছাপা আর ওয়েবের মাঝে ক্লিক বসে আছে। আঙুলে ছোঁয়াও তুমি কবিতার ঘ্রাণ...