পৃথিবী নামক একটি গ্রহের কবি বিনয় মজুমদার ।। তৈমুর খান

 
 
 kobi binay majumdar mohool in
 
 
 
পৃথিবী নামক গ্রহটি আমাদের কাছে চিরদিন রহস্যময়। আর এই রহস্যময়তার ছবি খুব বেশি করে দেখেছিলেন কবি বিনয় মজুমদার। তাঁর সূর্যাস্ত-সূর্যোদয়, দিন-রাত্রি-ভোর এবং গোধূলির সময় নিরীক্ষাকে তিনি আপন অনুভূতির সরল সমীকরণে ধরেছিলেন। এমনকী সেখানে চন্দ্রগ্রহণ - সূর্যগ্রহণ থেকে প্রচলিত লোকাচার পর্যন্ত তাঁর লেখায় এসে উপস্থিত হয়েছিল। সরল স্বীকারোক্তির ভেতর নিজের অবস্থানটি তিনি উল্লেখ করেছিলেন। প্রশ্ন, ব্যাখ্যা ও সমাধানে পৌঁছেছিলেন। শুধু সময় নয়, সময়ের পর্যবিলাসী মানুষও তাঁর কাছে গ্রহের উপাদান। এক একটি বিশেষণ উল্লেখ করে, এমনকী বিশেষ্যের ভেতরেও তাদের দাঁড় করিয়ে তিনি গ্রহের বিচরণশীল অভিজ্ঞতার নির্জ্ঞান দর্শনে নিয়ে যান। তাই খুব সাদামাটা বিষয়কেও অসাধারণ প্রাত্যহিকে আবহমানকালের দিকে ঠেলে দেন। ‘সৌন্দর্য’, ‘ঔদার্য’, ‘সভ্যতা’, ‘ডালা’ ইত্যাদি নামে সম্বোধন করেন এক একটি চরিত্রকে। মানব-মানবীরা সেই প্রসঙ্গেই কবির ব্যক্তি জীবনেও প্রতিফলিত হন । দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্ম থেকে হাঁটাচলারও ঘুমানো-জাগারও এবং স্বপ্ন দেখা কথা বলারও হিসেব তিনি দেন। চাওয়া-পাওয়ার হিসেবে তাঁর কোনো দীর্ঘশ্বাস পড়ে না। গ্রাম-শহর, রেললাইন, চায়ের দোকান, পাখির ঝাঁক, মাঠের রাস্তা,
 জলভর্তি খাল-বিল,  খাল-বিলে মাছ সবকিছু দেখেন তিনি, আর দেখতে দেখতেই বৃদ্ধ হয়ে যান।  আর বৃদ্ধ হয়ে নিজের কথা বলেন এভাবেই : 
 
" প্রৌঢ় বয়সেও আমি প্রায়শ দাঁড়াই দৃঢ় হয়ে,
 
 তার কিছুক্ষণ পরে আবার নেতিয়ে পড়ি আমি।"
                                                   (সন্ধ্যায় বৃষ্টি) 
 
 কিন্তু সারাজীবন ধরে তিনি যত বৃষ্টিপাত করেছেন  তার একটা আত্মদর্শন প্রৌঢ় বয়সেও পেশ করলেন, যা চিরন্তনতার দরবারে পৌঁছে গেল : 
 
"বৃষ্টি পতনের কথা কোনোদিন গোপন থাকে না।"
 
 নিজের গ্রাম শিমুলপুরে তিনি কতবার ফিরে এসেছেন  সেটা যেমন সত্য, তেমনি গ্রামের মানচিত্র কবিতার ভৌগোলিক দর্শনে ফুটে উঠেছে :
 
" বাড়ির নিকট দিয়ে রেলগাড়ি চলে যায় বেশ শব্দ করে ।"
 
 তারপর রাত্রি নামলে নিশীথের জ্যোৎস্না আসে,  কখনো জোনাকি। ঋতুচক্রে মাস-বছর পেরিয়ে যান তিনি।  কখনো কখনো পৃথিবীকে একটাই দেশ ভাবেন। আর সব রাষ্ট্রগুলি এক একটি অঙ্গরাজ্য।  একজনই শাসক এসে এই দেশ শাসন করুক। এরকমই গ্রহের ভেতর মানুষের লীলা অথবা জটিল সম্পর্ক  নিয়েও তিনি ভেবেছেন। ভেবেছেন শৈশব থেকে বৃদ্ধ হওয়া পর্বগুলির কথাও। সেখানেই জীবনরসের ভাড়ার খুলে পেয়েছেন  গাণিতিক সূত্র, স্বাস্থ্যবিধির নানান উপাদান। তেমনি উদ্ভিজ্জ, ঋতুচক্র এমনকী পরিযায়ী পাখির কথাও তাঁর লেখায় উদ্ভাসিত হয়েছে।  এইসবের ভেতরেই নিজের অবস্থানটি যাচাই করেছেন। আর নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে এক দার্শনিক সত্যের নির্ণীত পর্যটনে পৌঁছে গেছেন। তাই ফল, পাখি,  শস্যখেত, নদী, রেলগাড়ি ,কারখানা ইত্যাদির দ্বারা  আকৃষ্ট হলেও পৃথিবীর আকর্ষণকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। আর তারপরেই সেই দার্শনিকের দৃষ্টিতে আত্মোন্মোচন ঘটেছে : 
 
"গ্রহসমূহের দাড়ি দেখি আমি,রোজ দেখি তারকাদির কানে দুল । 
 
 মানুষ অত্যন্ত ঊর্ধ্বে উঠে গেলে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের
 
বাইরে যায় সে তাকে কেউ আর আকর্ষণ করে না, সে থাকে
 
 সব গ্রহতারকার আকর্ষণহীন স্থানে একা।" ( আকর্ষণ )
 
 অর্থাৎ আকর্ষণ শেষপর্যন্ত বিকর্ষণেও পৌঁছে যায়।  আমরা জানি, 'প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে'( নিউটন)।  এখানেও সেই সূত্র অনুযায়ী বিনয় মজুমদার মাধ্যাকর্ষণের শেষ সীমানা নির্দেশ করেছেন , যেটা ঊর্ধ্বাকর্ষণ। কারণ কবির আকর্ষণ এই গ্রহময় শুধু মাটির টান নয়, নিসর্গ টানও। তাই মাটির কথা বলতে গেলেই নিসর্গের কথাও অাসে : 
 
" বিশ্বের ভিতরে বাস করি আমি, ঘুরি ফিরি বিশ্বের ভিতরে।
 
 অগণন তারা আছে শোবার কিছুটা আগে তারা দেখা যায় 
 
 এবং করুণ নেত্রে তারারা আমার দিকে চেয়ে থাকে বলে মনে হয়
 
আমার বিছানা ঘিরে।  এভাবে আমার এই জীবন চলেছে ।"
                                                  ( বিশ্বের ভিতর)
 
 এই বিশ্বের ভিতরে কবির কাছে একটা মানুষও বিশ্ব।  আবার একটা মানুষীও সভ্যতা। কোনো কৃষক ব্যক্তি বিশ্বের কৃষক হয়ে যান।  কোন প্রেমিকা যুবতী 'সভ্যতা' নামে উল্লিখিত হতে পারেন। আবার 'ডালা' নামে কোনো নারীও বিশ্বের নারী হয়ে যান।  কবি কোনো বিদ্যালয়ের বালককে বিশ্বের বালক ভাবেন। এইভাবে সমস্ত ব্যক্তি বিশ্বের ব্যক্তি হয়ে যান। একজন চাষি কবির বাড়ি দেখা করতে এলে  কবি দেখেন : 
 
" বিশ্বের চাষিরা আসে মাঝে মাঝে আমার বাড়িতে।"
 
 গ্রামে একজন ছাত্র কলকাতা পড়তে গেলে  তিনি লেখেন :
 
" এ বিশ্বের বহু ছাত্র আমাদের এ অঞ্চল থেকে কলকাতা গিয়ে পড়ে।" 
 
 কোনো মুদি দোকানদারও কবির কাছে   "এ বিশ্বের মুদি"।
 
 গ্রামের ফুলগাছ, কুলগাছ, বেলগাছ এ বিশ্বের ফুলগাছ, কুলগাছ, বেলগাছে পরিণত হয়।  ভৌগোলিক গন্ডি যেমন ভেঙে বৃহৎ বিশ্বের গন্ডি হয়ে যায়,  তেমনি খণ্ডিত মানুষও রহস্য, ঔদার্য, সৌন্দর্য সকলেই মানুষের বিশিষ্টতা পায়। যেমন খন্ডিত মাধুর্য ব্যক্তিসত্তার আরোপে কবির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, কবির নাড়ি টিপে চলে যায়। আর তারপরেই কবি তাকে খোঁজেন : 
 
"সমুদ্র, নক্ষত্র, চাঁদ, নদ, ফুল সহজেই একসঙ্গে কলরব করে।
 
 ওদের যা ভেবে নিলে অধিক মাধুর্য আসে ওরা তাই, এরপর তাকে পাওয়া যায়।" ( মাধুর্য)
 
 ঠিক এভাবেই রহস্যেরও দেখা মেলে, যে রহস্য চিরদিন কবির কাছে অধরা।  দুঃখে, কান্নায়, ঘুমে-স্বপ্নে এবং ভূ-পর্যটনের বিস্ময়ের এই রহস্যকে কবি স্পর্শ করেন। যে রহস্যকে বারবার ছুরি মারার কল্পনায় আত্মহত্যা বন্ধ থাকে কবির :
 
" রহস্যের পরিবর্তে প্রাপ্তির বা মাধুর্যের পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দিয়েছি
 
 এই দৃশ্য দেখি  কিনা দেখাও সম্ভব কিনা , কিন্তু বহু প্রচেষ্টা করেও
 
 তা দেখা যায় না  আমি সর্বদা— প্রত্যেকবার গভীর রহস্যকেই দেখি।" 
                                                         ( রহস্য) 
 
 রহস্য, মাধুর্য, প্রাপ্তি  সবগুলি বিশেষণ হলেও এক একটি চরিত্রের মতো। যেমন 'সৌন্দর্য' কবিতায় কবি সৌন্দর্যের সিঁথিতে সিঁদুর দেখে  তার পরিবর্তন লক্ষ করেন :
 
" কী করে কিশোরী থেকে ক্রমশ যুবতী হলো তা দেখেছি আমি।" 
 
 তেমনি 'ঔদার্য' কবিতায় বিকেলবেলায় হাঁটতে দেখেছেন  
 
কন্যার সঙ্গে ঔদার্যকে : 
" অল্প কিছু কথা বলে চলে গেল, ঔদার্যকে কখনো ছুঁইনি।"
 
 নারী শরীর কখনো শ্লেট,কখনো থালা। অর্থাৎ মৃত্তিকার মতো শরীর থেকে নতুন শরীরের জন্ম দেয়। যেমন 'ডালা' যুবতী নারীদের চিত্র হয়ে ওঠে : 
 
" আমাদের প্লাটফর্মে ভোরবেলা দশটায়  বহু ডালা ঝড় হয়েছিল,
 
 
 এক ডালা খুব ফর্সা, বই হাতে বহু ডালা—এসব অল্পবয়স্কা ডালা"
                                                     ( নাচানাচি)
 
 এসব ডালাদের খাতাস্রাবের পর নাচের প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ এই নাচতো জৈবকর্মের তাড়না। 'খাতাস্রাব' কথাটি ঋতুস্রাব এর বিপরীত । মনন-মানবীর  আত্মক্ষুধায় আত্মপ্রকাশের মাধ্যম। কিন্তু পরোক্ষে সৃষ্টি প্ররোচনাকেই বোঝায়। সর্বব্যাপী  বৈশ্বিকবোধে ঠাকুরনগরও কবিতায় বিশ্বের নগর হয়ে যায়। ঠাকুরনগরের মেয়ে আবহমানকালের মেয়ে হয়ে যায়। তার শূন্যতা বিশ্বের শূন্যতায় সকল মানুষের হৃদয় শূন্যতায় মিশে যায়। ঠিক 'সভ্যতা' কবিতায় সভ্যতাও নারী ;  তার প্রেম, মাধুর্য, নাচানাচি জৈব ক্রিয়ার নিরন্তর সমীক্ষণটি কবি গোচরে আনেন, আর আমাদের কাছেও তুলে ধরেন :
 
" সে সভ্যতা আমাকে তো দাদা দাদা বলে ডাকে
 
 তারমানে আমার সহিত  কখনো নাচার ইচ্ছা তার নেই
 
 একথা সে প্রথম সাক্ষাতে জানিয়েছে ।"
 
 কবিতায় যে  Eternal-humanity এবং  Time-weaving ব্যাপারটা থাকে কবি তাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। সেই কারণেই 'মানুষ' হয়েছে 'মানব', 'ক্ষণ' হয়েছে 'প্রবহমান সময়' ।  সেখানে শেষ পূর্ণচ্ছেদ টানা সম্ভব নয়। কারণ এই চিরন্তন ও প্রবহমান ধারায় মিশে আছে প্রবৃত্তি। সুতরাং দশক-শতকে, গ্রাম-শহরকে ভাগ করা যায় না।  কবি চিরন্তন পৃথিবী নামক এক গ্রহের মানুষ হয়েই যেন মানবের অমোঘ আইন ঘোষণা করেছেন কবিতায়। আর এসব কারণেই বিনয় মজুমদারকে গ্রহবাসী মনে হয়। অসীম কালব্যাপী এক শাশ্বত মানুষ হয়ে ওঠেন তিনি।  বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংস এর মতো তাঁর কবিতাও Big-Bang তত্ত্বে পর্যবসিত হয়েছে। এই তত্ত্বে দেখা যায় প্রথমে Space ও time একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে থেকে কীভাবে singularityতে ছড়িয়ে পড়ে। এবং তখন থেকে আবার  time-count শুরু হয়। বিনয় মজুমদার তাঁর ভাবনাকে এভাবেই মুহূর্ত থেকে মহাশূন্যে নিয়ে যান, বিন্দু থেকে তা বিস্ময়ে মিলিয়ে যায়। তখন বিজ্ঞানচেতনার এই তত্ত্বের মতো আবার তাকে খুঁজে পেতে আমরা সময়-সমীক্ষা ও মানব-রসায়নের দ্বারস্থ হই । 
 
 

একক কবিতা সন্ধ্যা



মহুল ওয়েব প্রকাশিত বিভিন্ন সংখ্যা



করোনা Diary



আমাদের কথা

আমাদের শরীরে লেপটে আছে আদিগন্ত কবিতা কলঙ্ক । অনেকটা প্রেমের মতো । কাঁপতে কাঁপতে একদিন সে প্রেরণা হয়ে যায়। রহস্যময় আমাদের অক্ষর ঐতিহ্য। নির্মাণেই তার মুক্তি। আত্মার স্বাদ...

কিছুই তো নয় ওহে, মাঝে মাঝে লালমাটি...মাঝে মাঝে নিয়নের আলো স্তম্ভিত করে রাখে আখরের আয়োজনগুলি । এদের যেকোনও নামে ডাকা যেতে পারে । আজ না হয় ডাকলে মহুল...মহুল...

ছাপা আর ওয়েবের মাঝে ক্লিক বসে আছে। আঙুলে ছোঁয়াও তুমি কবিতার ঘ্রাণ...