শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়, শুধু এই... ।। সুকান্ত সিংহ

sambhunath chattapadhyay

শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায় চলে যাবার পরে সম্ভবত আমরা কেউ কেউ অনুভব করতে পেরেছি তাঁর কবিতার মতো, তাঁর থাকাটিও আলতো ছিল। যেমন আলতো ছুঁয়ে থাকে পেনসিল হারিয়ে ফেলার সেই কবেকার স্মৃতি, যেমন ছুঁয়ে থাকে আমাদের সমস্ত ঘুমের ভেতর বিকেলের শেষ রোদ, ঠিক তেমনি করেই আলতো ছুঁয়ে থাকাটি ছিল শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়ের। কবিতার মধ্য দিয়ে। হ্রেষাধ্বনি ছুটিয়ে যেসব অবশ্যম্ভাবী কবিতা ইতিপূর্বে এসেছে, তাদের থেকে অনেকখানি সরে পায়ে হেঁটে এসেছে তাঁর  কবিতা। তিনিও কি নন? সে-হাঁটাতে লেগে আছে ধুলো। লেগে আছে ভোরের শিশির। পাখির বাসা। জাজিমে বসবার জন্য যেইসব লেগে-থাকাদের ধুয়ে ফেলেন নি তিনি। যেভাবে এসেছিলেন, সেভাবেই থেকেছেন, চলে যাওয়াটিও ঠিক সেই ভাবেই। আলতো। একটু অগোছালো ভাবে। যেন এমন একটি মনোভাব, এলুম, যেতে বললে চলে যাবো।

স্মরণাতীতকালে কারো এত সহজ অথচ গভীর এই আলতো আসা, থাকা, আর চলে যাওয়ার কথা মনে পড়ছে না। অথচ, কেন জানি না বারংবার আমার মনে হয় তাঁর কাছে একটা গোটানো পট ছিল, যেখানে যমুনার জল আর কালীয়দমন ছিল আলামাটি ঘষে ঘষে রঙ তুলে আঁকা। ছিল নৌকাবিলাস। ছিল ননী চুরি। তিনি কখনো সেই পট সম্পূর্ণ খোলেন নি!

এই কথাটির পর বিস্ময়সূচক চিহ্নটি থাক।

বাংলাবাজারে যে সকল মিথ দাপট দেখায়, একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাওয়া যায় সেখানে কবিতার চেয়ে কবি সম্পর্কীয় মিথ বেশি ঢেউ তুলেছে। এইসব মিথ গড়ে তুলে বাংলাবাজার বহুদিন থেকে পাঠকের পড়ার টেবিলে কবিতা নয়, কবির মিথ পৌঁছে দিয়েছে। ফলে, মিথহীন কবির কবিতা পড়তে আমাদের দেরি হয়ে যায়। ততদিনে আরো নতুন নতুন মিথ এসে পড়ে। সেসব ডিঙিয়ে আসতে গেলে সময় লাগে। অনেকটা সময়। এলে বোঝা যায় অবগাহন কাকে বলে।

শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়ের জন্য কোনো মিথ ছিল না। আজো নেই। শুধু কবিতা রয়েছে। মৃদু। বাইরে নিশ্চুপ। ভেতরে সাতসমুদ্রের ঢেউ। যেখানে কবিতার যাতায়াত পরা থেকে বৈখরীর দিকে -- 'পরা বাক্ মূলচক্রস্থা, পশ্যন্তি নাভিসংস্থীতা। হৃদিস্থা মধ্যমা জ্ঞেয়া,বৈখরী কণ্ঠদেশগা।'  সেখানে শম্ভুনাথের কবিতা অনেকাংশেই বিপরীত যাত্রা করেছে, বৈখরী থেকে পরার দিকে। জীবনানন্দ পরবর্তী এমনটা শুধু গুটিকয়েক দেখি, মণীন্দ্র গুপ্ত, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, আলোক সরকার, শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়। এখানে পূর্ণচ্ছেদ রইল। কেউ চাইলে তুলে দিতে পারেন। আপত্তি করব না।

কোনোদিনই কি তাঁর কবিতা খুব বেশি  আলোচ্যসূচিতে ছিল? আমাদের? যেটুকু হয়েছে তা ওই দিনান্তের খুদকুঁড়ো। এই যে তথাকথিত কবিতার আলোচকরা শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা নিষ্ঠার সাথে এড়িয়ে রইলেন, আমি একে সন্ত্রাস বলি। আরেকটি সন্ত্রাস দেখতে পাই, কোনো মৃদু উচ্চারণের কবিতা দেখতে পেলেই তাকে জীবনানন্দ দাশের সাথে জুড়ে দেবার সন্ত্রাস। অগ্রপথিকের তাতে  বাড়ে না কিছু, বরং পরবর্তীকে একটা ঘেরাটোপে রেখে দেওয়া যায়। এগুলো হল দেগে দেওয়া-- তুমি ওঁর মতন। লক্ষ্যও করে না ওঁর মতোটা কবেই নিজের মতো হয়ে গেছে! কবিতা পাঠের পূর্বস্মৃতিই শুধু তাড়িয়ে ফেরে যাদের, তাদের থেকে এর বেশি কিছু আশা করা বৃথা। এক হয়, তারা কাউকে মতো-দাগে দেগে দেয়, নয়তো তারা কারো প্রতিস্পর্ধী করে দেয়। 

শম্ভুনাথের কবিতা শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো। হ্যাঁ, স্বাভাবিক আর স্বতঃস্ফূর্ত ছিল তাঁর কবিতা। আছে। আর এখানেই সেগুলি স্বতন্ত্র। তিনি কবিতাতেই রেখেছিলেন তাঁর শ্বাসের শব্দ। শ্বাসকষ্ট। সবটাই। এটা জন্মসূত্রে পাওয়া ভোগদখলের খাতিয়ান নয়, এ হল অর্জন। কারো কারো ক্ষেত্রে এই অর্জন খুবই প্রকট ভাবে প্রকাশ পায়। কেউ কেউ এই অর্জনকে শান্ত ভাবে নিজের মধ্যে ধরে রাখতে পারেন, তার প্রকাশ কোনো মঞ্চে নয়, কেবল কবিতার মধ্যেই দেখে যায়। সেখানে, যদি দেখি, দেখব, থাকে স্ব-উপার্জিত বোধের তীব্রতা। একে এড়িয়ে থাকতে পারি। এড়িয়ে থাকাই স্বস্তিদায়ক। কিন্তু একে পড়তে পড়তে অন্যমনস্ক হবার কোনো উপায় থাকে না। উপায় থাকে না এই কারণে যে, বাচনের রীতি ও রূপের যে-সকল কাঠামো আমাদের আশেপাশে সদা-বিদ্যমান, সেখানে কোথাও কোথাও মিল খুঁজে পেলেও, এই বোধের তীব্রতা যেন এতকাল অদেখাই ছিল। এক দিগন্তবিস্তৃত পরিসর যেন এতকাল রয়ে গেছে ভ্রমণবিহীন। এ দৃশ্য রূপসাদৃশ্য খুঁজে ফেরার কাছে অসোয়াস্তি জাগবে বইকি।

এই অসোয়াস্তি আসলে নিজের মধ্যে তৈরি করা বেড়া ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে আসে। ভেতরের ফাঁকফোকর স্পষ্ট হয়ে যাবার দুর্মর ভাবনা থেকে আসে। নতুন কিছু নয়-পুরাতনও নয়, তাহলে কী? এই অনিবার্য প্রশ্নের সামনে পড়ে যাবার থেকে আসে। এড়িয়ে যাওয়াই ভাল। এড়িয়ে গেলেই আর কোনো দায় থাকে না।

অনেকগুলো দশক পেরিয়ে এসেছে বাংলা কবিতা। উচ্চারণের ভিন্নতা, শব্দের ব্যবহার, বাঁকবদল, এসব নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে অনেক। কখনো তা হয়েছে জোট বেঁধে, কখনো হয়েছে একক ভাবে। তুল্যমূল্য বিতর্ক হয়েছে। ভিন্ন ভাষার কবিতার সাথে নিক্তি মাপাও কম হয় নি। তৈরি হয়েছে গোষ্ঠী। গোষ্ঠী ভেঙেছে। কেউ কেউ সোচ্চারে নিদান দিয়েছে কবিতা কাকে বলে। কেউ কেউ কবিতার দিকে যাবার পথনির্দেশিকা ঝুলিয়ে দিয়েছে।

এমন কিছু তিনি কখনো করেছিলেন বলে শুনিনি। এমন কিছু করার কোনো প্রয়োজন অনুভব করার দরকারও তাঁর ছিল না। ওগুলো তাদের দরকার হয় তাদের, যারা রুমাল থেকে পায়রা উড়িয়ে দেখানোতে ব্যস্ত থাকে। খেলা শেষ হলে পকেটে রুমাল আর খাঁচাতে পায়রা ভরে নিয়ে চলে যায়। কিছু দিন পর আবার  ফিরে আসে খাঁচাতে পায়রা আর পকেটে রুমাল নিয়ে। এটাকে ম্যাজিক বলে। হাতের কারসাজি যার মূলধন। নিপুণ হতে হয় হাতসাফাইয়ে। নিপুণ কিছু শব্দ দিয়ে পঙক্তির জাল বোনার মতো। কোনো ম্যাজিক ধরা পড়ে গেলে যেমন তার মজা শেষ হয়ে যায়, যতক্ষণ না ধরা পড়ে ততক্ষণ তার স্বস্তি, তেমনই পাঠকের কাছে স্বস্তি পৌঁছে দেওয়া কিছু পঙক্তি চিরকাল প্রাধান্য পেয়েছে। এটা অর্জন নয়, প্র্যাকটিসের সুফল।

হাত কেঁপে গেলে যেখানে শুরু, সেখানেই শেষ।


শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায় কবিতা লিখেছিলেন। বাংলা ভাষার। বাংলা ভাষায়। যে-ভাষার নিজস্ব গন্ধ আছে। যাকে সঙ্কুচিত প্রসারিত করা যায়। দেখিল শব্দ থেকে অদেখার দিকে যাওয়া যায়। যদি সত্যিই কেউ যাবার উদ্যোগ করে। শব্দ থেকে শব্দাতীতে।

অন্নে যেমন ক্ষুধা জেগে থাকে, শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় তেমনি জেগে থাকে এক কর্ষিত না-হওয়া পরিসর। যার আছে এক গাঢ়, গাঢ়তর আকর্ষণ। ছলনা নয়, আকর্ষণ। বপনে উন্মুখ শুধু সৎ-চাষী জানে ওখানে মুঠোর বীজ হারিয়ে ফেলতে হয়। হারিয়ে ফেলতে পারলে, তবেই আবার মুঠোর বীজ দুনো হয়ে ফিরে আসে। একজন সৎ-চাষী জানে এসব, এক এক বীজ, ফুটে উঠতে এক এক সময় নেয়।

দ্যুতিময় পঙক্তির দিকে তাঁর ঝোঁক দেখি না। যেটুকু ঝোঁক তা দ্যোতনার দিকে। নুড়িপাথর কুড়োতে গেলে একটু ঝুঁকতে হয় যেমন, সেইটুকুই ঝোঁকা। বৃত্তে রুদ্ধ হবার আগেই বেঁকেচুরে বৃত্তকে সম্পূর্ণ না-করা আছে। কূটাভাষ? আছে।

শুধু যা নেই, কোনো ভাবেই নেই, তা হল চমকে দেওয়ার বাঁধাধরা গৎ।

কিন্তু, হ্যাঁ, খুব সাবধানে একে হাতে নিতে হয়। এতে বিষ আছে। খর নয়। ধীর। কখন যে সেই বিষ বোধের সীমাবদ্ধ অনুভূতি খুলে দেবে, কেউ জানে না। দাহ আছে। আলোবাতাসের মতো দাহ।

আমি চাই অন্তত একবার, আপনার সাথে, শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়ের এই কবিতাটি পড়তে। আপনি নিশ্চিত থাকুন, আপনার কণ্ঠস্বর আমি ঠিক শুনতে পাবো, হে অদৃশ্য পাঠক --


রেখে যাও
--------------

বিনষ্ট করো না -- রেখে যাও :
এই সব জলচর প্রসন্ন পাখির মেলা,
       নীল হ্রদ,
       সবুজের দিব্যশোভা উপত্যকা,
              দেবদারু ছায়া, বনভূমি,
যেখানে যেমন আছে রেখে যাও নিসর্গ-জগৎ।

স্বর্গপৃথিবীর আলো আজ এই সোনালি সকালে
তোমার হৃদয় ছুঁয়ে যাক।
          জলজ কুসুম
          দ্যাখো কত বিশ্বাসে ফুটেছে -
ছিন্ন শিহরণে যেন বিবর্ণ করো না রূপশোভা,
       অপলক
       চোখের আনন্দে শুধু দৃশ্যগত গভীরতা
               অনুভব করো,
যেখানে যেমন আছে রেখে যাও নিসর্গ-সুষমা।

        তুমি চলে গেলে,
এই নীল জলজ কুসুম হ্রদ উপত্যকা সবুজ প্রবাহ
তখনো উজ্জ্বলতর দেখা যাবে পাহাড়ের কোলে;
অমলিন -- সব রেখে যাও।

 

একক কবিতা সন্ধ্যা



মহুল ওয়েব প্রকাশিত বিভিন্ন সংখ্যা



করোনা Diary



আমাদের কথা

আমাদের শরীরে লেপটে আছে আদিগন্ত কবিতা কলঙ্ক । অনেকটা প্রেমের মতো । কাঁপতে কাঁপতে একদিন সে প্রেরণা হয়ে যায়। রহস্যময় আমাদের অক্ষর ঐতিহ্য। নির্মাণেই তার মুক্তি। আত্মার স্বাদ...

কিছুই তো নয় ওহে, মাঝে মাঝে লালমাটি...মাঝে মাঝে নিয়নের আলো স্তম্ভিত করে রাখে আখরের আয়োজনগুলি । এদের যেকোনও নামে ডাকা যেতে পারে । আজ না হয় ডাকলে মহুল...মহুল...

ছাপা আর ওয়েবের মাঝে ক্লিক বসে আছে। আঙুলে ছোঁয়াও তুমি কবিতার ঘ্রাণ...