সোনাঝুরি
কেশব মেট্যা
রুপু চার বছরে পা দিল। খেলনাবাটির দিন জমে উঠছে উঠোনময়। লাহাগিন্নি আগের কথা ভাবতে চায় না আর। কত কোবরেজ‚ মানত‚ শহরের ডাক্তার দেখিয়ে দেখিয়ে প্রায় দশ বছর পর তাদের এই রুপু। মায়ের কাছে এখন দুলে দুলে অ আ ক খ পড়ে। মা যত বলে----‘ছোটো খোকা বলে অ-- আ। শেখেনি সে কথা কওয়া।’ রুপু চোখ বড় বড় করে বলে ‘খোকা কেন? আমি তো খুকু।’ ঙ ঞ তো বলবেই না। ওটা নাকি সোনাঝুরিই বলবে। সোনাঝুরিও বড্ড নেওটা। রুপু ছাড়া সে কিছুই বোঝে না। বিকেলে রুপুর এক গ্লাস দুধ তো সোনাঝুরির এক বাটি।
গ্রাম তো আর গাঁ নেই। গায়ের গন্ধ মুছে ফেলে সে শহর হতে চায়। জুটিয়ে নিচ্ছে মফসসল নাম। মোরাম রাস্তা পিচে ঢাকা হল। রাস্তার দু’পাশে বড় বড় বাড়ি। গাড়ি ছুটছে হু হু করে। পাড়ায় পাড়ায় এখন কত শাহরুখ সলমন। সঙ্গে বাইক আছে কিনা !
যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে লাহাবাবু রুপুকে স্কুলে ভর্তি করলেন। কত রঙিন রঙিন বই। কত ছবি। রুপু এসব সোনাঝুরিকে দেখায়। মাছের ছবি দেখলেই সোনাঝুরি বদমায়েশিটা একটু বেশিই করে। সে ভাবে‚ রুপুর সঙ্গে যদি স্কুল পর্যন্ত যাওয়া যেত কত মজাই না হত !
ঘড়িতে দশটা তিরিশ। রুপুর ছুটি। লাফাতে লাফাতে সঙ্গে এল সোনাঝুরি। লাহাবাবুর অনুমতি না পেয়ে অগত্যা এপারেই বসে থাকা। পিচ রাস্তার ওপারে স্কুল। সোনাঝুরি খুব ব্যস্ত হয়ে উঠল বসে থাকতে থাকতে। সক্কাল থেকে কতক্ষণ আর এভাবে রুপুকে ছেড়ে থাকা যায়।
ওই তো বাবার হাত ধরে নাচতে নাচতে আসছে রুপু। সোনাঝুরিকে দেখতে পেয়ে আহ্লাদে আটখানা। কাঁধ থেকে ব্যাগটা নিয়ে তাড়াতাড়ি বাবার হাতে দিল। সুযোগ বুঝেই এক দৌড়। আর ঝ্যাঁক করে ব্রেক কষে দাঁড়াল বাইকটা। তারপরই স্পিড। ততক্ষণে স্কুল ফ্রক ভিজে লালে লাল !
সেইদিন থেকে সোনাঝুরিও ফিরল না লাহাবাড়ি। এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। মাসখানেক পর তেখালি ব্রিজের ধারে সেই বাইকটাকে দোমড়ানো মোচড়ানো অবস্থায় পাওয়া যায় ! হাসপাতালের বেডে শুয়ে খুব কাঁপতে কাঁপতে বাইক চালানো সেই ছেলেটা জানিয়েছিল--- সে সোনাঝুরিকে চিনে ফেলেছে ! বলেই জ্ঞান হারায়। সে-জ্ঞান আর ফেরেনি।
তারপর থেকে শুধু বাইক নয়‚ বড় বড় গাড়িও ঝ্যাঁক করে থেমে যায়। কেননা‚ সোনাঝুরিরা রাস্তা পেরোয়।
পেরোতে পেরোতে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে---ম্যাঁও!