'তবে পরানে ভালোবাসা কেন গো দিলে
রূপ না দিলে যদি বিধি হে ' -
এ আক্ষেপ নিজের কাছেই । ভালোবাসা চাই - ভালোবাসা চাই - ভালোবাসতে চাই - ভালোবাসতে চাই , আজ চিৎকার করে বলতে হচ্ছে । যেমন করে বিন্দু বিন্দু জলকনা নদী হতে চায়, স্রোত হতে চায় , সমুদ্র হতে চায় । যেমন করে গাছ সবুজ হতে চায় , ফুল ফোটাতে চায়, ফল ফলাতে চায় । এই বোধটুকু জন্মায় তখনই - যখন গোপনে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে ওঠে সত্তা ।
বিপন্নতা না এলে ঠিক সেখানে যেতে চাই না , যেখানে সুন্দর । আশঙ্কা না থাকলে তার ধারও মাড়াতে চাই না , যেখানে সত্য । কেননা আমাদের চারপাশে এত রোশনাই , এত সাইনবোর্ড , এত কাট আউট তার নিচে আমরা সব আলেয়া-পথিক । কিন্তু আামাদের ' আছে আছে স্থান । / একা তুমি, তোমার শুধু এক আঁটি ধান । / না হয় হবে ঘেঁষাঘেঁষি / এমন কিছু নয় সে বেশি - / না হয় কিছু ভারী হবে আমার তরীখান - / তাই বলে কি ফিরবে ? আছে , আছে স্থান । '
অন্তিমে এসে মানুষ শুরুর দিকে ফিরে যেতে চাইবে , এটাই স্বাভাবিক । যেমন এতদিন কেউ পৃথিবীর কথা ভাবতে চায় নি - আগুন জ্বালিয়েছে তার শরীরে - পৃথিবী জ্বলতে জ্বলতে তার নিজের জ্বালার কথা বলেছে । কেউ অনুভব করতে চায় নি সেই যন্ত্রণা । দুষিত হতে হতে সে বলেছ শ্বাসকষ্টের কথা । কেউ শুনতে চায় নি । ধোঁয়ায় ভরা পৃথিবীতে ফুরিয়ে যাচ্ছে শ্বাসবায়ু । অবজ্ঞা করছে চঞ্চলতা । তার জন্য মানুষের কোন আবেগই ছিল না ।
কিন্তু হে অন্তর - ’ নীরব বাঁশরি খানি বেজেছে আবার - '
ফিরে আসে আবেগ , ফিরে আসে তার একেবারে সূচনা কালের ছবি । যাত্রাপথ, স্কুল পালানো , প্রাণের ধ্বনি । সেই মধুর স্বর , সেই মাধবীলতা , সেই ভেজা মাটির গন্ধ । যা অবচেতন অন্তরে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার হয়ে কুলুঙ্গিতে গচ্ছিত ছিল। আজ তীব্র হয়ে ওঠেছে তার স্মৃতি-অতীত আকুতি ; এবং খুবই স্পষ্টভাবে । সহজভাবে বলতে গেলে, সময় দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে , রূপ পাল্টাচ্ছে প্রকৃতির , মানুষের মূল্যবোধে পরিবর্তন আসছে , প্রাকৃতিক তৎপরতার কারনে আপাত অর্থে চলছে অন্তর শোধনবোধ , ফিরে আসছে ঐতিহ্য , সাংস্কৃতিক প্রত্যয় , বিলীন হচ্ছে ঝলমলে নিজস্ব প্রকরণ , স্বপ্ন গান কথা গল্প ।
উল্টে যাচ্ছি নিজের পাতাগুলো । কত কিছু লেখা আছে প্রতিটি পঙক্তিতে। পড়ছি 'ছোট খোকা বলে অ আ '। পড়ছি 'কাল ছিল ডাল খালি / আজ ফুলে যায় ভরে। / বল দেখি তুই মালি হয় সে কেমন করে । ' জানি না , আজও বুঝতে পারিনি কেমন করে ফুল ফোটে । এটি যুক্তির ধার ধারে না। এটি বলতে দেয় না ফুল ফোটার শর্ত কি ছিল । শুধু অন্তরে জমা ফুল গণ্ডি পেরোতে চায় , বন্দিদশা থেকে চায় মুক্তি । মুক্তি বললাম এই কারণে যে, সংগীতের মতন স্বাধীন হবার প্রসঙ্গটি এসে যাচ্ছে বারবার । থেকে থেকে বেজে ওঠে অন্তর । কেঁপে ওঠে বাদ্য মর্মর । কৃতজ্ঞ সুন্দরের কাছে সে সুর ' দে দোল দোল , দে দোল দোল / এ মহাসাগরে তুফান তোল / বধূরে আমার পেয়েছি আবার , ভরেছে কোল - '/
বসবাসের এসব মর্মযাতনা ও বেদনা এখন মিস্টিক হলেও সত্য । জীবনের কালপর্বগুলোর অনিবার্যতা অন্তর্সত্যকে ক্লাসিক্যাল জায়গাটি চিনিয়ে দেয় - উন্মোচন করে প্রাণের সৌন্দর্য । আমি গুনগুন করে গাইতে থাকি ' এ কি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ, প্রাণেশ হে - '
এই পাওয়ার মাঝেই আমার বর্তমান । যার নাম রোদ।